১২৪ কোটি টাকা শুধু পরামর্শক খাতেই ব্যয়
দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে পরামর্শকদের পেছনে। কোনো প্রকল্পই পরামর্শক ছাড়া বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্যও ১২৪ কোটি টাকা পরামর্শকদের দিতে হবে তাদের কাজের জন্য। প্রকল্প চলমান অবস্থাতেই প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যয় বাড়ছে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর সাত বছরের প্রকল্পে সাড়ে পাঁচ বছরে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। অগ্রগতি ঢিমেতালে হলেও সার্বিকভাবে প্রকল্প ব্যয় ২৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। আর এই সংশোধিত প্রস্তাবনা আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদনের জন্য পেশ করা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবনায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের ৯ উপকূলীয় এলাকায় ৫৫৬টি নতুন করে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়ে ২০১৫ সালে। দুই হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি আগামী ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হওয়ার কথা। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীসহ উপকূলীয় জেলার ৭৪টি উপজেলায় জনগণের জানমাল ও গবাদিপশু রক্ষায় মোট ৫৫৬টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করার কথা এই প্রকল্পের মাধ্যমে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে মোট ৯ হাজার ২৫০টি সাইক্লোন শেল্টার দরকার। কিন্তু বর্তমানে আছে ৩২৬৮টি। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৫৬টি নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ছাড়াও ৪৫০টি সাইক্লোন শেল্টার মেরামত করা হবে। ফলে ১০০৬টি সাইক্লোন শেল্টার বর্তমানের ৩২৬৮টির সাথে যোগ হবে। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৩৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। তবে অর্থ ব্যয় হয়েছে ৩০ শতাংশ বা এক হাজার ১১১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
এলজিইডির ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই প্রকল্পে প্রকিউরমেন্ট প্যানেল পরামর্শকদের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৩৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এক হাজার ৮০ দিনের জন্য এই খরচ হবে। ফলে প্রতিদিন ব্যয় হবে প্রায় ৯৬ হাজার টাকা। আর ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শকদের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১১৩ কোটি ৪০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এখানে প্রতিদিন ব্যয় হবে চার লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দুটো মিলে দৈনিক পরামর্শক ব্যয় পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই ব্যয় অত্যাধিক বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। আর স্থানীয় প্রশিক্ষণের জন্য ৫৫ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পের ব্যয় ২৩৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে এখন ৩ হাজার ১৭০ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ৩ হাজার ১৬০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক। বাকিটা বাংলাদেশ সরকারের। এই প্রকল্পের আওতায় ৫৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রথমে এক হাজার ৭৩৫ কোটি ১৯ রাখ টাকা। রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে এখন এই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২ হাজার ৫০৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ফলে প্রথমে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ খরচ ছিল ৩ কোটি ১২ লাখ ৮ হাজার টাকা। এখন সেই ব্যয় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ছেড়ে গেছে। ফলে প্রতিটি ব্যয় বাড়ছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু চলমান অন্য একটি প্রকল্প ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্পে ৩৬০টি সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে প্রতিটিতে ব্যয় হচ্ছে ২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, একই প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজে তিনি জেলায় ১৮৩টি সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণের জন্য সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে গত ২৭ মার্চ ক্রয় প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। প্রতিটি শেল্টারের ব্যয় অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে অধিক হওয়ায় হালনাগাদ রেট শিডিউলের সাথে সমন্বয় করে প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন করে ক্রয় কমিটিতে উত্থাপনের সুপারিশ করা হয়। প্রকল্পে ১৮৩ সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণকাজের চুক্তি হয়নি। ওই সবের জন্য প্রস্তাবিত চুক্তি মূল্য হলো এক হাজার ৬৯০ কোটি ২৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ফলে এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যয় হবে ৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অন্য দিকে, ৪৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রের সংস্কার বা উন্নয়নের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ৩১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এখন এটাকে কমিয়ে ৯০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা করা হয়েছে।
এলজিইডি বলছে, ২০১২ সালের রেট শিডিউল দিয়ে কাজ শুরু করা হয়। এখন এই রেট শিডিউল ২০১৮ সালের। ২০১৮ সালের শিডিউলের দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে। যার কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাথে টাকার বিনিময় হারের তারতম্য। এছাড়া বিভিন্ন অঙ্গের বা খাতের ব্যয় সমন্বয় করা হয়েছে। শেল্টারের মূল ডিজাইনের পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিটি শেল্টারের ব্যয় বেড়েছে।
এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে চলমান অবস্থায় ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লাগের (সিপিডি) গবেষণা পরিাচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তার অভিমত হলো- সাত বছরের এই প্রকল্প স্বাভাবিক নিয়মে বাস্তবায়ন করা হলে ২০১৯ সালের জুনে সাড়ে ৪ বছরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা কিন্তু হয়েছে অর্ধেকের মতো বা ৩৭.১৮ শতাংশ। সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য হিসাব ধরেই ব্যয়ের হিসাব করার কথা। এক্ষেত্রে সেটা করা হয়েছে কি না তা দেখার কথা। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে ৬৪ শতাংশ কাজ হয়ে যেত। বাকি কাজের জন্য আন্তঃখাত সমন্বয়ের জন্য এতটা ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না।
তার মতে, এখন দীর্ঘ সময়ের প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকারকে বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এতে সরকারের কোষাগারের মধ্যে একটা চাপ পড়তে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিটি কাজ শেষ করতে না পারার কারণে সরকারও উপলব্ধি করতে পারছে। সেই সাথে প্রকল্পে ব্যয়ও বাড়ছে। তাতে করে রাজস্বের উপর একটা চাপ পড়বে। অন্যান্য ছোট প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বিষয়টির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সময় বাড়ানো এবং ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে একটা স্বার্থ রয়েছে। এতে করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির প্রবণতা দেখা যায়। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিষয়গুলো নিজেরা নজরে রাখেন।