‘হাত ধোয়া’ তত্ত্ব আবিষ্কার করে সবার চক্ষুশূল, অত:পর করুণ মৃত্যু
সেটা ছিল ছিল এমন দুনিয়া যেখানে জীবাণু সম্পর্কে সামগ্রিক কোনো ধারণা ছিল না আর হাসপাতালগুলোকে মনে করা হতো “মৃত্যুর ঘর”।
তেমনই সময়ে ইগনাজ স্যামেলউইজ প্রথম শনাক্ত করেন যে, পরিচ্ছন্নতা হলো জীবন বাঁচানোর উপায়। কিন্তু এই তথ্য প্রতিষ্ঠা করতে তাকে ব্যাপক মূল্য চোকাতে হয়েছে।
উনিশ শতকের কথা। সেটা ছিল এমন এক সময় যখন অসুস্থ কোনো ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেয়াকে কোনোভাবেই কাজের কথা ভাবা হতো না।
সর্বোপরি, ১৯ শতকের হাসপাতালগুলো ছিল সংক্রমণের কেন্দ্র এবং অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রীদের সেখানে কেবল সেকেলে চিকিৎসাই দেয়া হতো।
তখন প্রকৃতপক্ষে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করাটাকেই মনে করা হতো নিরাপদ। হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন মৃত্যুর হার তখন বাসা-বাড়িতে রেখে চিকিৎসার তুলনায় ছিল তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি।
মৃত্যুর ঘর
হাসপাতালগুলোতে প্রস্রাব, বমি এবং শরীর থেকে নির্গত অন্যান্য তরল সবকিছু মিলে এমন উৎকট গন্ধ তৈরি হতো যে কর্মীদের অনেক সময় নাকে কাপড় বা রুমাল বেধে চলাফেরা করতে হতো। চিকিৎসকদের তাদের হাত কিংবা চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ধোয়ার ঘটনা ছিল বিরল। এবং চিকিৎসকরা যেমন নোংরা-অপরিষ্কার থাকতেন, অস্ত্রোপচার কক্ষগুলোও তেমনই ছিল ।
ফলাফলস্বরূপ, হাসপাতালগুলোর পরিচিতি ছিল “মরণ ঘর বা মৃত্যুর ঘর” হিসেবে।
সেই বিশ্বে যখন জীবাণু কী সে সম্পর্কে ধারণা নেই, সেখানে একজন ব্যক্তি বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা শুরু করেন। তার নাম ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ।
হাঙ্গেরিয়ান এই চিকিৎসক ১৮৪০ সালে ভিয়েনাতে, মেটার্নিটি ওয়ার্ডগুলোতে মৃত্যুহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে হাত ধোয়ার প্রচলন করার উদ্যোগ নেন।
এটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ব্যর্থ একটি উদ্যোগ। কারণ যেহেতু তিনি সহকর্মীদের দ্বারা অসহযোগিতার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি মায়েদের ত্রাণকর্তা হিসেবে পরিচিতি পান।
জীবাণুবিহীন এক বিশ্ব!
স্যামেলওয়াইজ ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে কাজ করতেন, যেখানে সেসময়কার অন্য সব হাসপাতালের মতই মৃত্যু নিয়মিতভাবে মৃত্যু পিছু ছাড়ছিল না।
১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জীবাণু বিষয়ক তত্ত্বের সাফল্যের আগে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যে হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখছে সে সম্পর্কে অনেক চিকিৎসকেরই টনক নড়েনি।
“এমন এক দুনিয়ার কথা কল্পনা করাও আমাদের জন্য কঠিন যেখানে আমরা ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতামই না”।
কথাগুলো বলছিলেন, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের ওষুধের ইতিহাস বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্যারন এইচ লার্নার।
তাৎপর্যপূর্ণ ভারসাম্যহীনতা
সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঝুঁকিতে ছিলেন যারা তাদের মধ্যে প্রসূতি মায়েরা, বিশেষ করে যাদের প্রসবের সময় যৌনাঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়-উন্মুক্ত ক্ষতস্থান ব্যাকটেরিয়ার আদর্শ আবাসস্থল, প্রায়ই যার বাহক ছিলেন চিকিৎসক এবং সার্জনরা
প্রথম যে বিষয়টি স্যামেলওয়াইজ নোটিশ করেন সেটি হলো, ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালের ধাত্রীবিদ্যা সংক্রান্ত দুটি ক্লিনিকের মধ্যকার মজার একটি অসামঞ্জস্য, কিন্তু ক্লিনিকই দুটির সুযোগ-সুবিধা ছিল অভিন্ন।
একটি পরিচালিত হতো পুরুষ মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের দ্বারা, অন্যটি ছিল মিডওয়াইফদের তত্ত্বাবধানে।
পুরুষ মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ক্লিনিকটিতে ১৮৪৭ সালে প্রতি এক হাজার প্রসবের ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যু হার ছিল ৯৪.৪। আর দ্বিতীয় ক্লিনিক যেটি মিডওয়াইফদের দ্বারা পরিচালিত হতো সেখানে এই হার ছিল প্রতি হাজার প্রসবের ঘটনায় মাত্র ৩৬.২।
এই ভারসাম্যহীনতার জন্য অতীতে মনে করা হতো, রোগীদের সাথে মিডওয়াইফদের তুলনায় পুরুষ মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের কঠোর আচরণ দায়ী ।
ঠিক সেইসময় একটি মৃত্যু এবং কিছু প্রশ্ন!
তখন বিশ্বাস করা হতো যে, পুরুষ ডাক্তারদের এই কঠোর আচরণ মায়েদের শারীরিক এমন পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেত যা তাদের পিউরপেরাল জ্বরের দিকে ঠেলে দিতো-আর সন্তান-প্রসবের পরবর্তী প্রজনন-পথের সংক্রমণ আর সেই হাসপাতালটির সমস্ত মাতৃমৃত্যুর কারণ ছিল এটি।
কিন্তু স্যামেলওয়াইজ এই ধরনের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না।
এমন প্রেক্ষাপটে সেই একই বছর, তার একজন সহকর্মী মারা যান। সেই সহকর্মীটি একটি ময়নাতদন্ত করার সময় হাত কেটে যাওয়ার পর থেকে ভুগছিলেন-আর এটাই হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক সেমেলউইজের সামনে এনে দেয় সেই ক্লু বা সমাধান সূত্র যা তিনি খুঁজছিলেন।
সেইসময় উন্মুক্ত মরদেহ কাটা শারীরিক ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত ছিল যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
মরদেহ ব্যবচ্ছেদের ছুরি দিয়ে যেকোনো ক্ষত হলে বা চামড়ায় কোনো কাটা-ছেড়া হলে, তা যত সামান্যই হোক না কেন, সেটা ছিল মারাত্মক বিপদজনক, এমনকি বেশ অভিজ্ঞ অ্যানাটমিস্টদের জন্যও।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চার্লস ডারউইনের চাচা-যার নামও ছিল চার্লস ডারউইন যিনি ১৭৭৮ সালে একটি শিশুর মরদেহের ব্যবচ্ছেদ করার সময় ক্ষত সৃষ্টির পরে মারা গিয়েছিলেন।
ভিয়েনাতে নিজের সহকর্মীর মৃত্যুর পরে, সেমেলউইজ এটা বুঝলেন যে, তার উপসর্গ এবং পিউপেরাল ফিভারে ভোগা নারীদের উপসর্গ খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তিনি ভাবলেন এটা কি হতে পারে যে, ময়নাতদন্ত কাজ শেষে ডাক্তারেরা সেখান থেকে ‘কাডাভেরাস পার্টিকেল’ তাদের সাথে বহন করে তা প্রসব কক্ষে নিয়ে যাচ্ছেন?
তার পর্যবেক্ষণে উঠে আসে যে, অনেক মেডিক্যাল শিক্ষার্থী অটপসি (শবদেহ ব্যবচ্ছেদ) শেষ করে সরাসরি চলে যাচ্ছে মেটার্নিটি ওয়ার্ডে নারীদের চিকিৎসা দিতে।
যেহেতু সেইসময় মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করার সময় কেউই হাতে গ্লোভস বা অন্য কোন ধরনের সুরক্ষামূলক উপকরণ ব্যবহার করতো না, সুতরাং মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের ক্লাস শেষে যখন ওয়ার্ডে ঢুকে যেত তখন তাদের পরনের কাপড়ে মাংসের টুকরো বা টিস্যু লেগে থাকতে দেখা গেলে সেটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না।
“হাসপাতাল গুড়িয়ে দিয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে”
মিডওয়াইফরা অটপসি বা শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করতেন না। আর তাদের দ্বারা পরিচালিত ক্লিনিকে মৃত্যুহারও ছিল তুলনামূলক অনেক কম।
সেমেলউইজকে বিপর্যস্ত করে রাখা রহস্য-জট খোলার এটাই কি চাবিকাঠি?
জীবাণু তত্ত্ব সম্পর্কে বিশদ ধারণা লাভের আগে, হাসপাতালগুলোতে অপরিচ্ছন্নতা দূর করার বিষয়টি ছিল খুবই দু:সাধ্য কাজ।
প্রসূতি বিশেষজ্ঞ জেমস ওয়াই. সিম্পসন (১৮১১-১৮৭০)- যিনি মানবদেহের ওপর ক্লোরোফর্মের চেতনা-নাশক প্রভাবের বৈশিষ্ট্য প্রথম তুলে ধরেছিলেন, তিনি যুক্তি তুলে ধরেন যে, যদি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে হাসপাতালগুলো পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করতে হবে এবং আবার গড়তে হবে।
যদিও সেমেলউইজ এমন কোনো চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে বিশ্বাসী ছিলেন না।
মৃতদেহ থেকে “সংক্রামক বস্তু বা উপকরণ” থেকেই পিউপেরাল জ্বরের ঘটনা ঘটছে- সে বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর পর, হাসপাতালে তিনি ক্লোরিনের সাহায্যে হাত ও উপকরণ জীবাণুমুক্ত করার জন্য বেসিন চালু করেন।
যেসমস্ত ডাক্তারেরা ময়নাতদন্ত কক্ষ থেকে প্রসব কক্ষে যেত তাদের রোগীদের সেবা দেয়ার আগে অ্যান্টিসেপটিক সলিউশন ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেয়া হলো।
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ওয়ার্ডে মৃত্যুর হার কমে ১৮৪৮ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার প্রসবের ক্ষেত্রে ১২.৭( ১২ দশমিক সাত) এ নেমে আসে।
যে বিজয়ের কোনো পুরস্কার নেই
যদিও সেমেলউইজ এর সহকর্মীরা এ বিষয়ে পুরোপুরি একমত হয়নি যে, পিউপেরাল জ্বরের ঘটনা মৃতদেহের সংস্পর্শ থেকে আসা সংক্রমণের কারণে ঘটছে।
লার্নার ব্যাখ্যা করে বলেন, এটা মাথায় রাখতে হবে যে তিনি (সেমেলউইজ) কী বলেছেন-যদিও সরাসরি বলা হয়নি- মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা এই নারীদের মেরে ফেলছে, এবং এটা মেনে নেয়া তো খুব কঠিন ছিল”।
এই বিষয়ে প্রকাশ করা একটি বইয়ের প্রচুর নেতিবাচক পর্যালোচনার পর, সেমেলউইজ তার সমালোচকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং যেসমস্ত চিকিৎসক হাত পরিষ্কার করতেন না তাদেরকে “ঘাতক” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
অত:পর ভিয়েনা হাসপাতালের সাথে চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর তা পুনরায় নবায়ন না হলে, সেমেলউইজ নিজ দেশ হাঙ্গেরিতে ফিরে যান। এরপর বুদাপেস্টের একটি হাসপাতালে তিনি প্রসূতি-বিদ্যা বিভাগে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে অবৈতনিক পদে যোগ দেন।
সেখানে এবং ইউনিভার্সিটি অব পেস্ট-এর মেটার্নিটি বিভাগে কাজ করেন। সেখানে তিনি পিউপেরাল জ্বরের বিস্তার নিয়ে শিক্ষা দেন। কিন্তু তার তত্ত্বের সমালোচনা থামলো না, এবং তার প্রবর্তিত পদ্ধতি অনুসরণের বিষয়ে সহকর্মীদের অনীহা সেমেলউইজের ক্রোধ বাড়িয়ে দেয়।
১৮৬১ সাল নাগাদ তার আচরণে অসঙ্গতি দেখা দেয় এবং চার বছর পরে সেমেলউইজকে মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
একজন সহকর্মী তাকে একটি নতুন একটি মেডিক্যাল ইন্সটিটিউট দেখানোর নাম করে ভিয়েনিজ অ্যাসাইলামে রেখে আসে।
যখন সেমেলউইজ বিষয়টি বুঝতে পারলেন তখন তিনি সেখান থেকে পালাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু কারারক্ষীরা তাকে পরিয়ে দেয় স্ট্রেটজ্যাকেট (ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী অথবা মানসিক রোগী যাতে অন্যকে আঘাত করতে না পারে সেজন্য বিশেষ পোশাক)। এবং এরপর তাকে অন্ধকার সেলের ভেতর আটকে রাখা হয়।
তার ডান হাতের ক্ষত থেকে সংক্রমণ হয়। এবং দুই সপ্তাহ পরেই মারা যান ৪৭ বছর বয়সী সেমেলউইজ।
শেষপর্যন্ত লুই পাস্তুর, জোসেফ লিস্টার এবং রবার্ট কোচ যে পরিবর্তনের পথ-প্রবর্তক সেখানে সেমেলউইজ হয়তো তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন না।
যাই হোক পরবর্তীতে সেমেলউইজ পুনর্বাসিত হয়েছেন যেভাবে: বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণ ঠেকানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়গুলোর একটি হিসেবে হাত ধোয়া এবং পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। হাত ধোয়ার গুরুত্ব তুলে ধরায় ১৯ শতকের এক ডাক্তারকে একঘরে এবং উন্মাদ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল।