সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে : ফখরুল

December 03 2019, 06:41

দেশে অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকারকে দায়ী করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছার ওপরই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য নির্ভরশীল। খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রব্যমূল্যসহ জনজীবনের সকল স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সহনীয় মাত্রায় রাখতে হলে একটি জবাবদিহিতা মূলক সরকার গড়ে তুলতে হবে।

দেশের স্বাধীনতা, সার্বোভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার জন্য অবিলম্বে এই অবৈধ ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনের সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় শুধু দ্রব্যমূল্য ভিত্তিক মানুষের দৈনিন্দন জীবনের সমস্যাই নয় জাতির গোটা ভবিষ্যত জীবন আরো অসহনীয় ও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

আজ মঙ্গলবার সকালে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, মীর সরফত আলী সপু, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, মোঃ মুনির হোসেন প্রমুখ।

লিখিত বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে-এটাই জনগণের দাবি। কিন্তু বর্তমান মিডনাইট সরকারের বাংলাদেশের জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। কারণ তাদের সরকার গঠনের জন্য জনগণের ভোটের কোনো দরকার হয়নি এবং আগামী নির্বাচনে তাদের জনগণের ভোটের কোনো দরকার নেই।

তারা নির্বাচনের খোলসে দলীয় আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনের ঘাড়ে ভর করে গায়ের জোরে পুনরায় সরকার গঠন করতে চায়। কিন্তু জনগণ তাদের এই গণবিরোধী ষড়যন্ত্র আর বরদাশত করবে না। একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের তত্বাবধানে আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এই স্বৈরাচারী, জালিম সরকারকে উচিত শিক্ষা দেবে।

তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পেছনে যেসব বিষয় ও ঘটনা প্রধান অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখে আমাদের সাধারণ সমগ্র জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে জগদ্দল পাথরের ন্যায় জাতির ঘাড়ে বর্তমান ভোটারবিহীন সরকারের লাগাতার দখলদারিত্ব।

অবৈধ দখলদার সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সমাজের সকল ক্রিয়াশীল অংশকে বিকল করে রেখেছে। ফলে সমাজে নিয়তই বেড়ে চলেছে ঘুষ, দুর্নীতি, টাকা পাচার, লুটপাট, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট বাণিজ্য। ঠুঁটো জগন্নাথ পার্লামেন্ট কেবলই সরকারের ক্ষমতার একটি লেবাস।

ফলে সরকারের নেই কোনো জবাবদিহিতা জনগণের প্রতি নেই কোনো দায়বদ্ধতা। আর এই জবাবদিহিতা বিহীন পরিস্থিতি নিশ্চিত করতেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায় ভাবে কারাবন্দি করে রেখেছে এই স্বৈরাচারী সরকার।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশবাসীর কাছ থেকে তাদের ভোটারধিকার আর নাগরিক মর্যাদা কেড়ে নেয়ার পর তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-শান্তিও একের পর এক কেড়ে চলেছে এই ভোটারবিহীন গণবিরোধী সরকার। ২৯ ডিসেম্বরের প্রহসনমূলক “মিডনাইট নির্বাচন’’ পরবর্তী রাজনৈতিক সংকট, পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির চিত্র এবং গুম, খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় গোটা রাষ্ট্র যখন গণতন্ত্র ও আইনবিহীন হয়ে পড়েছে তখন তার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

যার সর্বশেষ প্রমাণ পেঁয়াজ, চাল, ডাল, তেল, লবণ থেকে শুরু করে সকল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের এই অগ্নিমূল্য লাগাতারভাবে আমাদের সাধারণ জনজীবনকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে সে বিষয়ে বর্তমান ভোটারবিহীন অবৈধ সরকারের ব্যর্থতা ও উদাসীনতা বিষয়ে দেশবাসীকে অবগতকরণের অংশ হিসেবেই আজ আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি।

তিনি বলেন, পেঁয়াজের দুর্মূল্য নিয়ে গত কয়েকমাস ধরে আমরা কথা বলছি। দেশের সকল গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিদিন রিপোর্ট বের হচ্ছে। সরকার প্রধান নিজেও “পেঁয়াজ বিমানে উঠে গেছে, আর কোনো সমস্যা নাই’’ বলেই এয়ার শো দেখতে দুবাই থেকে ইডেনে গার্ডেন হয়ে এখন আবার মাদ্রিদ শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আর এদিকে পেঁয়াজের ঝাঁজ এখন চাল, ডাল, লবণ, তেল, আদা, রসুন শুরু করে শীতকালীন সকল সবজিতে সংক্রমিত হয়েছে। মোটকথা দৈনন্দিন জীবনে রান্নার জন্য ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিষের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমানার বাইরে চলে গেছে। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা গত কয়েক দিনে প্রকাশিত কিছু সংবাদ শিরোনামই পরিষ্কার করে।

মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকার পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে জনগণকে পেঁয়াজ খেতে নিষেধ করছে। তাহলে চালের মূল্য কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা, আটার মূল্য ৫ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তারা এখন কি বলবেন! ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিতে? রুটি খাওয়া বন্ধ করে দিতে?
ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, সুতরাং তেল খাওয়াও কি বন্ধ করে দিতে হবে? আপনাদের কি মনে হয় এটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? আসলে কোনো সরকার যারা জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে জনগণের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নেন তারা একথা কখনোই বলতে পারেন না।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের নির্বাচনের বিভিন্ন জনসভায় এবং আওয়ামী লীগের প্রচার প্রপাগান্ডায় লাগাতারভাবে প্রচার করেছে, “১০ টাকা সের চাউল খাওয়াবো, ঘরে ঘরে চাকুরী দেবো।” অতএব, আমরা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাজারে দ্রব্যমূল্যে বাড়লে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে সরকারের! জনগণ কী খাবে! কী খাবে না তা নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের না! এর ব্যত্যয় ঘটার কোনো সুযোগ নাই।

যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে তার একটাই কারণ! সেটা হচ্ছে, এই সরকার জনগণের সরকার নয়!

এই সরকার একটি ভোট ডাকাত সরকার! তাই জনগণের জীবনযাত্রা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা গত কয়েকদিনের বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য তালিকা দেখলেই প্রতীয়মান হবে। এসময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করেন বিএনপি মহাসচিব।

মির্জা ফখরুল একজন শিক্ষার্থীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহতায় মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে তার পুরোটা আমাদের জানা সম্ভবই হয় না। গ্রাম থেকে আসা এক শিক্ষার্থীর সহজ স্বীকারোক্তি হচ্ছে এরকম- “বাজারে সব্জির মূল্য বৃদ্ধির ফলে সব্জি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ বাজারে এমন কোনো সব্জি নাই যার মূল্য ৮০ থেকে ১০ টাকার নীচে……..! প্রশ্ন ছিলো তাহলে তাদের খাদ্য তালিকায় কী থাকে?

উত্তর ছিলো ডিম এবং যথারীতি এক বাটি পানি সমৃদ্ধ ডাল! তাও ১টা ডিম দুজনে ভাগ করে খায়! এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান ভোটারবিহীন সরকারের দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার অসহনীয় ফলাফল!
মির্জা ফখরুল বলেন, বিশ্বের সমগ্র দেশেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বাড়ে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথেই বা বাড়ার আগেই সরকারের কাজ হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা । যার ফলশ্রুতিতে বাজার খুব তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরকার, ব্যবসায়ী উৎপাদকের মাঝে গভীর সমন্বয় সাধন করা।

সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন একটা দক্ষ ও গণবান্ধব সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। দ্রব্যমূল্যের বর্তমান অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রধান ও অন্যতম কারণ হচ্ছে বর্তমান অবৈধ ভোটারবিহীন ফ্যাসিবাদ সরকার। যার যাত্রা শুরু ১/১১ নামধারী অগণতান্ত্রিক সরকারের সময় কাল থেকে। এবং তাদের প্রেতাত্মা বর্তমান অবৈধ সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে।

তিনি বলেন, অর্থনীতির স্বাভাবিক নীতিমালা এবং সরকারের দক্ষতার উপরই নির্ভর করে মূলতঃ দ্রব্যমূল্যের সার্বিক অবস্থা। এ প্রসঙ্গে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বর্তমান অবৈধ ভোটারবিহীন সরকার যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ তা আমাদের প্রিয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সময়ে সরকারের দ্রব্যমূল্যের সার্বিক চিত্রের সাথে বর্তমান ফ্যাসিবাদ দখলদার সরকারের সময়কালের মূল্য তালিকা তুলে ধরলে সমগ্র বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হবে।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিগত ১৩ বছরে জিনিষপত্রের মূল্য গড় হিসেবে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। অনেক জিনিসের মূল্য বেড়ে ৩ গুণ হয়েছে। অথচ এসেনসিয়াল কমোডিটিস এ্যাক্ট অনুযায়ী সরকার ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে।

এই সরকারের প্রতিশ্রুত ১০ টাকার চাল আমজনতা খেয়েছে ৭০ টাকায়। পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকটকে পুঁজি করে অতি মুনাফালোভী সরকারদলীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, আমদানিকারক, আড়তদার, মজুদদার ও খুচরা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। চাল, তেল, ডিম, আদা, রসুন, ময়দা, মরিচ, হলুদ, মসলা, চিনিসহ অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম।

মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে। বর্তমান সরকার একদিকে মুক্ত বাজারের দর্শনে বিশ্বাসী, অন্যদিকে নিজস্ব দলীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী। দলীয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা তৈরি ব্যবসায়ী জোট ভাঙতে না পারলে, টিসিবিকে শক্তিশালী ও সক্রিয় না করতে পারলে, দলীয় লোকজন দ্বারা পরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ না করতে পারলে এবং মধ্যস্বত্বভোগের ব্যবস্থা বন্ধ না করতে পারলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস করা সম্ভব হবে না। বক্তৃতা-বিবৃতি ও লোক দেখানো ভণ্ডামি দ্বারা আর যাই হোক, দ্রব্যমূল্য হ্রাস বা অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো কর্মসূচি হবে কি না? এই প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা কর্মসূচি পালন করেছি। আরো হবে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলে কি করবেন? জানতে চাইলে বলেন, আমরা আগেও কর্মসূচি পালন করেছি। আগামীতেও দিবো। জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শুধু বিএনপিকে প্রভাবিত করেনা।