শেকলবন্দী জীবন তাদের
মানসিক ভারসাম্যহীন দুই যুবক। তাদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, পীর, ওঝা, ফকির কাউকেই বাদ দেয়নি পরিবার। তবুও ভালো হয়নি তারা। তাইতো তাদের শেকলে বেঁধে রেখেছে পরিবার। এদের মধ্যে একজনের নাম আল মামুন- যিনি ২০ বছর ধরে এবং আরেকজন ইব্রাহিম- যিনি ১২ বছর ধরে শেকলবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন।
ঘটনা দুটি মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর ইউনিয়নের দুই গ্রামের দুটি পরিবারে।
জানা গেছে, জেলার সিরাজদিখানের বালুচর ইউনিয়নের খাসমহল বালুচর গ্রামের আব্দুল করিম ও তার স্ত্রী খাদেজা বেগমের একমাত্র ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী ইব্রাহীম। তিনি চার বোনের একমাত্র ভাই। বয়স ৩১ বছর হলেও ছোটবেলা থেকেই ইব্রাহীম ভালোভাবে কথা বলতে পারতেন না; কিন্তু সেই ছোট বেলা থেকেই বাবার কাজে সহযোগিতা করতেন তিনি। ১০-১২ বছর থেকে তার পাগলামো ভাব শুরু হয়। বিভিন্ন ফকির, ওঝা, ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বেসরকারিভাবে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিলেও সেখানে ভর্তি নেয়নি। এখন নিজ বাড়িতেই ১২ বছর ধরে শেকলে বাঁধা রয়েছে ইব্রাহিম।
ইব্রাহিমের বাবা আব্দুল করিম জানান, ‘পাবনা রাখি নাই, অন্য পাগলদের মারধর করতে পারে তাই। এখন তালা দিয়ে রেখেছি। টাকা নাই, চিকিৎসা কী দিয়ে করবো?’
মা খাদেজা বেগম বলেন, ‘ফকির ফাকরা করে হাসপাতালে নিয়েছি। পাবনা নিয়েছি ভালো হয় নাই। চারটা খাশি মানতি দিয়েছি। পীরে মহিষ চাইছে, ভালো হলে দিতাম। জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করেছি। এখন নিজেরা চলতে পারি না। তালা দিয়ে রেখেছি, তবে মন মানে না।’
অন্যদিকে বালুচর ইউনিয়নের খাসনগর দক্ষিণ পাড়া গ্রামের মো. হেলাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী জয়নব বিবির বড় ছেলে আল মামুন। বয়স ৩৩ বছর, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। তারা দুই ভাই, দুই বোন। তারও ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই পাগলামি শুরু হয়। পাবনা মানসিক হাসপাতালে বেসরকারিভাবে সাড়ে ৩ বছর চিকিৎসাধীন থাকার পর ২-১ মাস ভালো ছিলেন। এরপর আবার একই অবস্থা। বিভিন্ন ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়ে কোনো লাভ হয় নাই। এখন অর্থের অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। তাকে ২০ বছর ধরে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে।
আল মামুনের বাবা মো. হেলাল উদ্দিন জানান, ‘পাবনায় সাড়ে তিন বছর চিকিৎসা করে বাড়ি আনি। এরপর দুই মাস ভালো থাকার পর সেই একই অবস্থা। মাঝে মাঝে ছেড়ে দিলে সে মানুষের ক্ষতি করে। তাই ১৫-২০ বছর ধরে আটকে রেখেছি শেকল দিয়ে। তার বয়স ৩৩, চার ভাইবোনের মধ্যে সেই বড়।’
এ সময় মামুনের চিকিৎসায় সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই মা বলেন, ‘কত জায়গায় চিকিৎসা করালাম, ভালো হলো না। মানুষের সন্তান হাঁটে, আর আমার সন্তান বানদা থুইছি। আহারে! কেউ যদি ওরে ভালো কইরা দিতো। আমার বুকটা ছিঁড়া যায়।’
এ ব্যাপারে সিরাজদিখান উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. আজিজুর রহমান মাসুম জানান, তারা সম্প্রীতি জানতে পেরেছেন বালুচরে দুজন মানসিক প্রতিবন্ধী রয়েছে। একজন ২০ বছর, আরেকজন ১২ বছর ধরে শেকলবন্দী। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। তবে তারা নিজ উদ্যোগে সহযোগিতা ও ভাতা দিবেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হবে বলেও জানান ওই সমাজসেবা অফিসার।