রফতানির অর্ডার যাচ্ছে পাকিস্তান ও মিয়ানমারে
উৎপাদিত পণ্যমূল্য নিয়ে প্রতিযোগীদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না দেশের রফতানি খাত। কম পণ্যমূল্য দিয়ে অর্ডার নিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার ও পাকিস্তান। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরও অব্যাহতভাবে হোঁচট খেয়েই চলছে রফতানি আয়। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এসেও সেই পতন অব্যাহত রয়েছে। শুরুটা ইতিবাচক থাকলেও আগস্ট থেকে হোঁচটের কবলে পড়ে। তৈরি পোশাক, নিটওয়্যাার, ওভেন গার্মেন্টস, বিশেষায়িত বস্ত্র, চামড়া ও চামড়াজত পণ্য, কৃষি ও হিমায়িত খাদ্যসহ বেশির ভাগ খাতে গত দুই মাস ধরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
তিন মাসের লক্ষ্যমাত্রায় ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ আয় অর্জিত না হলেও আগের বছরের তুলনায় আয় ১১ দশমিক ০৫ শতাংশ বা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা কমেছে। ফলে গত বছরের তুলনায় আয় তো কমছেই, অন্য দিকে, এ বছরের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হচ্ছে না বলে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে। রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী কয়েক মাস রফতানির এই মন্দাভাব থাকবে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত রফতানির অর্ডার কমবে। সার্বিকভাবে রফতানি খাতটি আন্তর্জাতিকভাবে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। মূল্য সক্ষমতাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
রফতানিকারকরা বলছেন, রফতানির অর্ডার কমেছে। সাথে সাথে পণ্যের মূল্যও কমেছে। এ ছাড়া অবকাঠমোগত সমস্যা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে রফতানি বাণিজ্য কমেছে। রফতানি বাণিজ্য বাড়াতে প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে সরকারের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তা না হলে আগামীতে রফতানি আয় আরো কমবে। তারা বলছেন, এ ছাড়া ভারত, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও চায়নাসহ বিভিন্ন দেশের সাথে আমরা অনেক ক্ষেত্রে নানা সমস্যা ও সুযোগ সুবিধার অভাবে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছি। এসব কারণে রফতানি আয় কমছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছর দেশে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় চার হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। আর প্রথম প্রান্তিকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৮৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। প্রকৃত অর্জন হয়েছে ৯৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ০৫ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২.৯৪ শতাংশ কম। এই সময়ে প্রাথমিক পণ্যে ৯.৭২ শতাংশ নেতিবাচক এবং উৎপাদিত পণ্য খাতে ২.৬৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পাশাপাশি গত অর্থবছরের তুলনায়ও অর্জন কমেছে। তৈরি পোশাক খাতে ১.৬৪ শতাংশ, নিটওয়ারে ০.৮৭ শতাংশ, ওভেনে ২.৪৫ শতাংশ, হিমায়িত পণ্যে ৯.০৮ শতাংশ, কৃষিপণ্য খাতে ১০.০৩ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজত পণ্য খাতে ৫.০৬ শতাংশ, বিশেষায়িত বস্ত্র খাতে ২৫.০৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মোট রফতানি আয়ের অধিকাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ৯৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার রফতানি আয়ের মধ্যে ৮০৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের জোগান দিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। তবে এ খাতে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার আয় কমেছে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৮৭ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নিট পোশাক রফতানি থেকে এসেছে ৪১৭ কোটি ডলার। ওভেন পোশাক রফতানিতেও ছিল নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি।
অর্থাৎ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমে আয় হয়েছে ৩৮৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ছিল ৪৬১ কোটি ২৯ লাখ ডলার। একক মাস হিসেবে গত সেপ্টেম্বর মাসেও আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। সেপ্টেম্বরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ২৯১ কোটি ৫৮ লাখ ডালার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ কম। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায়ও আয় কমেছে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী এমপি জানান, আমরা লিংক পিরিয়ডটা অতিক্রম করছি। সামনের দিকে আমরা হয়তো উতরে উঠতে পারব। সার্বিকভাবে রফতানি খাতটি আন্তর্জাতিকভাবে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। তিনি বলেন, এই চ্যালেঞ্জগুলো হলো, আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশ তারা তাদের নীতি সহায়তা পাচ্ছে। আমরাও নীতিসহায়তা পাচ্ছি। তবে আমরা যে নীতিসহায়তা পাচ্ছি সে নীতিসহায়তা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ বলেন বা প্রতিযোগী দেশগুলো বলেন, তাদের সাথে আমরা প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারছি না। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে আমরা চেষ্টা করছি আমাদের সক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য। লিংক পিরিয়ড পার করেছি, সামনের মাসগুলোতে হয়তো আমাদের ভালো প্রবৃদ্ধি আসবে। হয়তো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। তিনি বলেন, মূল্য সক্ষমতাই আমাদের বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছি। যার কারণেই আমরা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছি।
রফতানিকারক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো: হাতেম জানান, গত আগস্ট মাস ঈদের কারণে ১০ দিন এই শিল্প বন্ধ ছিল। আর প্রতিযোগী দেশগুলোতে পণ্যমূল্য কম থাকায় অর্ডার নিয়ে যাচ্ছে তারা। তিনি বলেন, মিয়ানমারে অর্ডার যাচ্ছে ওভেন গার্মেন্ট এবং নিটওয়্যার যাচ্ছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানে পণ্যমূল্য প্রতিটিতে ১২ সেন্ট করে কম নিচ্ছে বাংলাদেশের তুলনায়। বাংলাদেশে যেখানে দর ১ ডলার ৪০ সেন্ট, সেখানে তারা নিচ্ছে ১ ডলার ২৮ সেন্ট। তিনি বলেন, সরকার টাকার অবমূল্যায়ন করতে গেলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে। সেটা না করে উচিত তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তা দেয়া। ভেল্যু অ্যাডিশন যেটুকু হবে তাতে বিশেষ ধরনের ছাড় দেয়া। তবে এটা করতে দেশী করলে অর্ডার ও বায়ার দুটোই হাতছাড়া হবে। তবে সহসা কোনো সমাধানের লক্ষণ দেখছি না।