যে অপরাধে সার্বোচ্চ শাস্তি পেলেন পারভেজ মোশাররফ

পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালত সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাকে এই শাস্তি দেয়া হলো। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম সাবেক কোনো সামরিক শাসককে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হলো।
মঙ্গলবার তিন সদস্যবিশিষ্ট আদালত বিভক্ত রায়ে (২-১) এই আদেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পেশোয়ার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওয়াকার আহমদ সেথের নেতৃত্বে গঠিত এই আদালতের অপর দুই সদস্য হলেন সিন্ধু হাইকোর্টের বিচারপতি নজর আকবর ও লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি শহিদ করিম।
১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করে মোশাররফ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন। পরে ২০০১ সালের ২০ জুন তারিখে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হওয়ার চার বছর আগে ১৯৪৩ সালে নয়াদিল্লির পুরান শহরটিতে জন্মগ্রহণ করেন পারভেজ। দেশ বিভাগের অল্প সময়ের মধ্যেই, তার বাবা-মা দিল্লি ছেড়ে পাকিস্তানের শহর করাচিতে চলে গিয়েছিলেন।
কূটনীতিকের সন্তান পারভেজ মোশাররফ করাচী এবং তুরস্কের ইস্তানবুলে বড় হন। লাহোরের ফরমান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে মুশাররফ গণিত নিয়ে ভর্তি হলেও পরিবারের অমতে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী কাকুলে যোগ দেন ১৯৬১ সালে। ১৯৬৪ সালে তিনি একাডেমী থেকে ২য় লেফটেন্যান্ট হিসেবে বের হয়েছিলেন।
২য় লেফটেন্যান্ট পদবীতেই তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আশির দশকে ব্রিগেডিয়ার পদবীতে তিনি একটি গোলন্দাজ ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব করেন। নব্বইয়ের দশকে মেজর-জেনারেল মুশাররফ একটি পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়কত্ব এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো বাহিনী ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ’ এর প্রধান অধিনায়ক হন। তিনি পরে সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি এবং ডাইরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন্স ডাইরেক্টরেট ছিলেন।
১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে পারভেজ মুশাররফের পদবী লেফটেন্যান্ট-জেনারেল থেকে পূর্ণ জেনারেল পদবীতে উন্নীত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। পূর্ণ জেনারেল হিসেবে পারভেজ সেনাবাহিনী প্রধান এবং চেয়ারম্যান অব দ্যা জয়েন্ট চীফস অব স্টাফ কমিটির দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
পারভেজ মোশাররফ এবং প্রধানমন্ত্রী শরীফ ১৯৯৮ সালের মে মাসে পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর কিছুদিন পর প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তানও পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শরীফের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পারভেজের তর্কাতর্কি থাকায় শরীফ পারভেজকে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জেনারেল পারভেজ এর জবাব হিসেবে নওয়াজ শরীফকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন ১৯৯৯ সালে; শরীফ গৃহবন্দী হন এবং তাকে রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেলে আটকিয়ে রাখা হয়।
পারভেজ দেশের শাসনক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে নিজের হাতে তুলে নেন এবং ২০০১ সালে চেয়ারম্যান অব দ্যা জয়েন্ট চীফস অব স্টাফ কমিটির পদ ছেড়ে দেন যদিও তিনি আর্মি চীফের দায়িত্বে থেকে যান। ২০০১ সালের ২০ জুন পারভেজ নিজেকে দেশের প্রকৃত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং ২০০২ সালের ১ মে তারিখে একটি রেফারেন্ডামের মাধ্যমে তিনি পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি থাকবেন বলে বলেন।
ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই পারভেজ দেশের অর্থনীতি এবং সমাজ-ব্যবস্থা পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দেন, তিনি ‘থার্ড ওয়ে’ রাজনৈতিক ধারার সমর্থক ছিলেন, তিনি শওকত আজিজকে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরো ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
জেনারেল পারভেজ ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামপন্থী জঙ্গীদের হামলার দ্বারা হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন যদিও প্রত্যেকবারই তিনি বেঁচে যান। ২০০২ সালে তিনি দেশের সংবিধানে পরিবর্তন আনেন। তিনি সামাজিক উদারনীতিবাদ এর একজন গোঁড়া সমর্থক ছিলেন এবং তিনি পাকিস্তানের জন্য ‘এনলাইটেন্ড মোডারেশোন প্রোগ্রাম’ চালু করেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘ইকোনমিক লিবারেলাইজেশোন’ শক্তভাবে চালু করে ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত “সন্ত্রাস বিরুদ্ধে যুদ্ধ” নামেও আফগানিস্তানে যে হামলা শুরু করে তার পুরোভাগে ছিলেন পারভেজচ। যুক্তরাষ্ট্রে হামলার দায়ে ২০০১ সালে ১/১১ হামলার পর আফগানিস্তান আক্রমণ করে মার্কিন বাহিনী। মোশাররফ বলেছিলেন, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ফোনে তাকে আলটিমেটাম দিয়েছেন যে: “আপনি আমাদের সাথে আছেন অথবা আমাদের বিপক্ষে।”
মোশাররফ আফগান তালেবানদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকা ও ন্যাটো পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার আফগানিস্তানে হামলার অনুমতি দেন ও পাকিস্তানের কয়েকটি অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন হামলার অনুমোদন দিয়ে যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করেন।
২০০৭ সালে তিনি সামরিক বাহিনীকে রাজধানী ইসলামাবাদের একটি মসজিদে হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একজন মুসলিম নেতা তার নির্দেশনা অমান্য করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উপর হামলার আদেশ দিয়েছিলেন। এসময় শতাধিক লোক নিহত হয়েছিল।
মোশাররফ ২০০৭ সালের নভেম্বরের আগে পর্যন্ত বিতর্কিতভাবে সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এ মাসেই তার শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজোয়ার শুরু হলে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। ৩ নভেম্বর সেনাশাসক জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও বিচারকদের আটকে রাখেন।
মূলত ২০০৭ সালের মার্চে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মাহমুদ চৌধুরীকে অবৈধভাবে অবসরে পাঠায় মোশাররফ। এরই প্রেক্ষিতে আইনজীবীরা আন্দোলন শুরু করলে রাজনৈতিক ও অন্যান্য গোষ্ঠীরাও যোগ দেয়।
অস্থির অর্থনীতি এবং পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়। সেনাবাহিনী প্রধান ও রাষ্ট্রপতির একই সাথে দুই পদ দখল করে রাখার জন্য চাপের মুখোমুখি হয়ে মোশাররফ তার উত্তরসূরি হিসাবে গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানিকে নিয়োগ দিয়ে সেনাপ্রধান থেকে পদত্যাগ করে বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হন।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে তিনি ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে জরুরী অবস্থা বাতিল করেন। পরবর্তীতে গণআন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান তিনি।
নাওয়াজ শরিফ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা করেন মোশাররফের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেন মোশাররফ। ২০০৯ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট জানায় দেশে জরুরি আবস্থা জারি ছিল অসাংবিধানিক। কেন রাষ্ট্রপতি হিসাবে জরুরি অবস্থা জারির পদক্ষেপ করেছিলেন পারভেজ মোশাররফ? আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট মোশাররফকে তলব করলে দেশ ছাড়েন তিনি।
২০১০ সালে তিনি অল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এপিএমএল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। তবে দলটি পাকিস্তানি ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এপিএমএল ২০১৩ সালে সংসদে একটি নির্জন আসন লাভ করেছিল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে কোনো আসনই পায়নি।
২০১৩ সালের নির্বাচনে মোশাররফের প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) আমলে এবছরই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিচার শুরু হয়েছিল।
অবশ্য ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আদালতের অনুমতি নিয়েই তিনি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করে দুবাই চলে যান। তারপর থেকে আর দেশে ফেরেননি পাকিস্তানের প্রাক্তন এই সামরিক শাসক।
ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার জন্য আদালতের অসংখ্য আদেশ সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেননি। পরে এবছর প্রধান বিচারপতি মোশাররফের সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়াই বিশেষ আদালতকে রায় দেওয়ার আদেশ দেয়। আল জাজিরা।