যুবলীগ নেত্রী পাপিয়ার উত্থান যেভাবে

February 25 2020, 03:25

এক শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায় থেকে পদপদবি ভাগিয়ে নেন বহিষ্কৃত মহিলা যুবলীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া। সেই শীর্ষ নেতার হাত ধরেই দীর্ঘদিন ধরে দেহব্যবসা, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। হোটেল ওয়েস্টিনে ‘প্রেসিডেন্ট স্যুট’ ভাড়া নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ চালাতেন পাপিয়া। তার বিডি স্কট সার্ভিস লিমিটেড নামে একটি নেটওয়ার্ক আছে। তাতে বিদেশী সুন্দরী তরুণীরাও আছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এদের দিয়ে মনোরঞ্জন করে মন যুগিয়েছেন ওপরওয়ালাদের। সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ীর সাথে যোগাযোগ ছিল তার।

এ দিকে জাল টাকা উদ্ধার, অস্ত্র ও মাদকের পৃথক তিন মামলায় গ্রেফতার নরসিংদীর জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক পাপিয়ার ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তার স্বামী মফিজুর রহমানেরও ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। গতকাল সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদুর রহমান ও মোহাম্মদ জসীম এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর মধ্যে বিমানবন্দর থানার জাল টাকা উদ্ধারের মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদুর রহমান পাঁচ দিন, শেরেবাংলা নগর থানার অস্ত্র ও মাদক আইনে দায়ের করা মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসীম পাঁচ দিন করে মোট ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বিমানবন্দর থানার মামলায় গ্রেফতার চারজন আসামি হলেও শেরেবাংলা নগর থানার মামলার আসামি কেবল পাপিয়া দম্পতি।

এর আগে তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। সেখানে জাল টাকা উদ্ধারের মামলায় ১০ দিন, অস্ত্র ও মাদক মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো পূর্বক ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। ঢাকা মহানগর হাকিম শাহীনুর রহমান তাদের গ্রেফতার দেখান ও আবেদন মঞ্জুর করেন।

অন্য দিকে তিন মামলায়ই রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। আদালত তা মঞ্জুর করেননি। শুনানি শেষে আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এ দিকে রিমান্ড আবেদনের প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করে, পাপিয়াসহ চার আসামি সঙ্ঘবদ্ধভাবে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, জাল নোটের ব্যবসা, চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, জমি দখল-বেদখল, অনৈতিক ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে এবং আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত বৈদেশিক মুদ্রার উৎস ও জাল টাকা তৈরি চক্রের সক্রিয় সদস্যসহ মূল হোতাকে গ্রেফতার, আসামিদের নিয়ে পুলিশ অভিযান পরিচালনা এবং ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ড একান্ত প্রয়োজন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যুব মহিলা লীগের বিতর্কিত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। এই দম্পতি ঢাকা ও নরসিংদীতে অবৈধ কাজ-কারবারের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তাদের এই অবৈধ কাজ-কারবারের পরিধি থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।

মন্ত্রী, কর্তাব্যক্তিদের মনোরঞ্জন
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাপিয়া ওরফে পিউ র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। জানা গেছে, ওই শীর্ষ কর্মকর্তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল ওয়েস্টিনে। নিয়মিত সকালের নাশতা ও মধ্য রাত পর্যন্ত তিনি থাকতেন ওয়েস্টিনে। পাপিয়া বেশ কিছু দিন আগে রাশিয়া থেকে ১২ নারীকে ঢাকায় এনেছিলেন। যাদের বিমানবন্দরে আটকে দেয়া হয়। কিন্তু ওই শীর্ষ কর্মকর্তা তাদের ছেড়ে দেন। তিনি নিয়মিত পাপিয়ার মাধ্যমে বেশ কয়েকজন সরকারদলীয় নেতা, কয়েকজন মন্ত্রীকে নারী সরবরাহ করতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে অবস্থান করে সুন্দরী যুবতীদের দিয়ে পাপিয়া পরিচালনা করতেন অবৈধ দেহব্যবসা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া ও তার স্বামী অনেক অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। কারো মাধ্যমে কোনো কাজ হাসিল করতে চাইলে সুন্দরী যুবতীদের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে পাপিয়া কৌশলে তার ডেরায় নিয়ে আসতেন। পরে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ক্লিপসের ভয় দেখিয়ে টার্গেট পূরণ করতেন তিনি। মানসম্মানের ভয়ে ওই ব্যক্তিরাও পাপিয়ার নির্দেশের বাইরে যাওয়ার সাহস দেখাতেন না। এরই মধ্যে পাপিয়া-সুমন দম্পতি তাদের ব্যবসার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছেন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। উদ্ধার করা হয়েছে শতাধিক ভিডিও ক্লিপসের একটি টিকটক ভিডিও। ওই ক্লিপসে দেখা যায়, পিস্তল হাতে পাপিয়া এক যুবককে টার্গেটে রেখে গুলি করার অভিনয় করছেন। এ ছাড়া তার অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও রয়েছে, যা তদন্ত কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখছেন। অভিজাত হোটেলের সুইমিংপুলে ৫-৬ যুবতী নিয়ে পাপিয়ার নাচ দেখা গেছে একটি ভিডিও ক্লিপে। এসব কিছুই খতিয়ে দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

এ দিকে এ দম্পতি গ্রেফতারের পরপরই নরসিংদীজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল বাইজি সর্দারনী বেশে পাপিয়ার ভিডিও। বেরিয়ে আসছে নারী নেত্রীর বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের কথা। মুখ খুলতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। পাপিয়া ও সুমনের নেপথ্যের কাহিনী গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এই সন্ত্রাসী দম্পতি এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। জানা গেছে, পাপিয়ার বাবা সাইফুল বারী একজন সাধারণ লোক। তার স্বামী সুমনের বাবা মতিউর রহমান চৌধুরী গানের শিক্ষক। সুমনের উত্থান শুরু ২০০০ সালে, কৈশোর থেকেই যার প্রধান পেশা ছিল চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্ল্যাকমেইল। একপর্যায়ে সুমন রাজনীতিবিদদের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়ে করেন পাপিয়াকে। তাদের ঘরে মাদহাত চৌধুরী ইসাব নামে আট বছরের একটি সন্তান আছে। বিয়ের পরপরই পাপিয়াকে রাজনীতিতে ব্যবহার শুরু করেন সুমন। ২০১২ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় ভাড়া বাসার সামনে শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক থাকা অবস্থায় সুমনের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন পাপিয়া। পরে তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও পাপিয়া সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এলাকায় তাদের বিশাল ‘কর্মী বাহিনী’ রয়েছে। শত শত লোকজন নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিটি মিছিল, সভায় তারা যোগ দেন। তাদের অনুসারীরা ‘কিউ অ্যান্ড সি’ ট্যাটু ব্যবহার করেন।

গত রোববার হোটেল ওয়েস্টিনে পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীর নামে বুকিংকৃত বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট রুম এবং ফার্মগেটের ২৮ নম্বর ইন্দিরা রোডের রওশন’স ডমিনো রিলিভো নামের বিলাসবহুল ভবনে তাদের দু’টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে বিদেশী পিস্তল, দু’টি পিস্তলের ম্যাগজিন, ২০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও বিদেশী মদ ও নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক ও কিছু বিদেশী মুদ্রাসহ ১০টি ব্যাংকের ভিসা ও এটিএম কার্ড জব্দ করে র্যাব। এর আগে গত শনিবার গোপনে দেশত্যাগের সময় পাপিয়াকে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলেন পাপিয়ার স্বামী ও তার অবৈধ আয়ের হিসাবরক্ষক মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন, পাপিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবা ও সাব্বির খন্দকার। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ জাল নোট, ৩১০ ভারতীয় রুপি, ৪২০ শ্রীলঙ্কান মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ মার্কিন ডলার ও সাতটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। র্যাব জানায়, পাপিয়ার প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। তবে এর আড়ালে জাল মুদ্রা সরবরাহ, বিদেশে অর্থপাচার এবং অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।