ভারতীয় পার্লামেন্টে অমিত শাহ’র বক্তব্য মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন : ফখরুল

December 22 2019, 11:12

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আলোচনায় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ভারতীয় পার্লামেন্টে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, কূটনৈতিক ভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন এক সোনালী অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দুই দেশের নেতারা প্রায়ই এমন দাবি করলেও ভারতের লোকসভায় অমিত সাহা বলেছেন সেই বন্ধু প্রীতম বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা এখনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে আমাদের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের নাম উচ্চারণ করে শিষ্টাচারবহির্ভূত ভাবে সরাসরি অভিযোগ করে বলেন বাংলাদেশ বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেখানে ব্যাপক হারে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে পালিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নকারী দল হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন।

রোববার বিকেল ৩ টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এসব কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত আছেন, স্থায়ী কমিটির সাদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।

মির্জা ফখরুল বলেন, হিন্দুত্ববাদী ভারত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে মিথ্যাচারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে এ অঞ্চলের রাজনীতিকে একটি অসুস্থ পরিবেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এদেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের কথা এড়িয়ে গিয়ে ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবে বিএনপির মতো একটি অতি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করায় এটি প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান ভারত সরকার তার সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাংলাদেশের জনগণের পরিবর্তে নতজানু আওয়ামী সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বেশি আগ্রহী ।

তিনি বলেন, বিএনপি দৃঢ়ভাবে মনে করে যে ,বিজেপির সভাপতি ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব অমিত শাহ এবং ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জনাব রাবীশ কুমার উভয়ের বক্তব্যই দুঃখজনকভাবে অসত্য, অপব্যাখ্যামূলক, একপাক্ষিক, বৈষম্যমূলক, বিভ্রান্তিকর এবং চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ । ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের উক্ত বক্তব্য আমরা দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করছি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের সময় বরাবরই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন ছিলো। এমনকি বাবরী মসজিদ সংকট এবং গুজরাট-দাঙ্গার সময়ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিলো। এককথায় বলতে গেলে, বিএনপির সব আমলেই তার সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতে সফল হয়েছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, নাগরিক সংশোধনী আইন(সিএএস)কে অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক, অসাংবিধানিক ও মানবতাবিরোধী আখ্যায়িত করে সারা ভারতে এখন প্রতিবাদ চলছে। কোথাও কোথাও এই প্রতিবাদ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।বিশ্ব গণমাধ্যমও এ বিষয়ে সোচ্চার। কেবলমাত্র সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে টার্গেট করেই এ আইন প্রণীত হয়েছে বলে আজ জনমনে বিশ্বাস স্থাপিত হয়েছে। এমনকি ভারতের অমুসলিম সম্প্রদায়ের বিবেকবান মানুষও এই বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করছে। তিনি বলেন, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছে। জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক দেশ ও বিবেকবান জাতিগোষ্ঠী এহেন বৈষম্যমূলক আইনের কারণে চরমভাবে উৎকণ্ঠিত। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) মার্কিন প্রশাসনকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করার সুপারিশ জানিয়েছে । আন্তর্জাতিক এই প্রতিক্রিয়ায় প্রমাণিত হয়, এই অসন্তোষ কেবলমাত্র ভারতের সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ক্রমান্বয়ে তা গোটা উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করবে। চরমভাবে আঘাত করবে এই অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় জনগণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা এবং ঐতিহ্যকে। যার সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাবের শিকার হতে হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সকলকে।

বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ-ভারত মধ্যকার তথাকথিত ‘সু-সম্পর্কের সোনালী অধ্যায়ের’ এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এনআরসি’র কারণে বাদপড়া নিরীহ ভারতীয় নাগরিকদের ‘উইপোকা’ আখ্যায়িত করে প্রত্যেককে ভারত থেকে বের করে দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আসামের গোয়ালপাড়ায় ইতোমধ্যেই ‘ডিটেনশন সেন্টার’ নির্মাণ করা হয়েছে। সারা ভারতে আরো অনেকগুলি ‘ডিটেনশন সেন্টার’ নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য আর একটি রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। এমনিতেই ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ ভারাক্রান্ত । এর ওপর এনআরসি উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার তাদের ব্যর্থ পররাষ্টনীতির প্রমাণ হিসেবে যেভাবে নির্বিকার রয়েছে, তা স্পষ্টতই আমাদের জনগণ, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের রাষ্টহীন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে, একইভাবে নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি জটিলতায় সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করে জোর করে বাংলাদেশে পুশ-ইন করার প্রক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করছি । অথচ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এনআরসি বিষয়টিকে বার বার ভারতের অভ্যন্তরীন ইস্যু আখ্যায়িত করে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে, এনআরসি ইস্যুতে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দেয়া সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে কোনো মৌলিক ব্যবধান নাই।

মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আশা করি, দু-দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সম্পর্কে ভারতীয় পার্লামেন্টে যে অসত্য বক্তব্য দেয়া হয়েছে, ভারত সরকার তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিবেন এবং ভবিষ্যত পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার লক্ষ্যে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রদানে বিরত থাকবেন। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরুর উপর ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।