প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের কর্মের ফল
মহান রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেনÑ ‘জলে-স্থলে যে বিপর্যয় (মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ) তা মানুষের কৃতকর্মের ফল। যাতে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা (আল্লাহর পথে) ফিরে আসে। বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে তা দেখো। তাদের বেশির ভাগই ছিল মুশরিক’ (আল কুরআন, সূরা রুম, আয়াত-৪১-৪২)। উল্লিখিত আয়াতে ‘কৃতকর্মের ফল’কে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত, পৃথবীতে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, তার কারণগুলো মানুষ ঘটায়। মানুষ উন্নত জীবন যাপনের জন্য বেশি কলকারখানা স্থাপন করছে, যানবাহন বাড়ছে, বেশি কার্বন নির্গত হচ্ছে, যার ফলে বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণে বরফ ঢাকা পর্বতের বরফ গলে যাচ্ছে। বিশাল মেরুপ্রদেশের বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশসহ সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলোর নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে ফসলের মাঠ, গাছপালা, বন, বিনষ্ট হচ্ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সাইক্লোন, টর্নেডোর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছেন বৈশি^ক উষ্ণতার সাথে ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে, বন্যা-খরা বাড়বে, মশা বৃদ্ধি পাবে, সেই সাথে মশাবাহিত রোগ যেমনÑ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদিসহ অন্যান্য রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। মানুষ ভূগর্ভস্থ পানি অপরিমিত ব্যবহার করছে ফলে আর্সেনিকের মাত্রা বৃদ্ধিসহ ভূমিধসের আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, উল্লিখিত আয়াতের মৌলিক ব্যাখ্যা হলোÑ মানুষ অন্যায় পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে। আল্লাহর হুকুমের অবাধ্য হচ্ছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে রোগব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে সতর্ক করছেন। যেমনিভাবে অতীতে বিভিন্ন শক্তিশালী জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করেছিলেন। নবী হুদ আ: সতর্ক করার পরও আদ জাতি আল্লাহর হুকুমের অবাধ্য হওয়ায় প্রথম তিন বছর তাদের জমিনে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ ছিল। তাদের ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়। তবু তারা সতর্ক হয়নি। ফলে সাত দিন আট রাত্রির বজ্রঝড়ে তারা সবাই মারা যায়। সামুদ জাতি হজরত ছালেহ আ:-এর অবাধ্য হয়। আল্লাহর কুদরতি উটকে হত্যা করে, নবী ছালেহ আ:কে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে আল্লাহ পাক প্রস্তর বর্ষণে ও বজ্রপাতের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করেন। হজরত লুত আ:-এর কওম, স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের পরিবর্তে সমকামিতায় লিপ্ত হয়। আল্লাহ পাক পুরো এলাকাটিকে জিবরাইল আ:-এর মাধ্যমে উল্টিয়ে দেন এবং তাদের ওপর প্রস্তর বর্ষিত হয়। ফলে লুত আ:-এর কওমের পুরো এলাকা সাগরে পরিণত হয় যা লোহিত সাগর বা মৃত সাগর নামে জর্দানের পাশে অবস্থান করছে। পৃথিবীর অন্যান্য সাগরে মাছসহ বহু জলজ প্রাণীর বসবাস কিন্তু লোহিত সাগরে মাছ তো দূরে থাক, কোনো জলজ প্রাণী জন্মে না।
নূহ আ:-এর সময় আল্লাহ পাক বন্যা দিয়ে অবাধ্যদের ধ্বংস করেন। আল্লাহ অবাধ্য ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মারেন, নবী মূসা আ:কে নদীর মধ্য দিয়ে পথ করে দেন। অবাধ্য ফেরাউনের লাশ আজো আমাদের জন্য নিদর্শন হিসেবে মিসরের জাদুঘরে রয়েছে। অবাধ্য জাকাত অস্বীকারকারী কারুনকে মাটির নিচে দেবে দেন। আল্লাহ পাক সামান্য মশা দিয়ে সমগ্র নমরুদ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। বর্তমানে যে ডেঙ্গুজ¦র, দ্বিতীয় স্তর থেকে মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায়। আল্লাহর জন্য দ্বিতীয় স্তর বা তার পরবর্তী স্তরের প্রয়োজন হয় না। সামান্য মশার মধ্যে এমন জীবাণু দিতে পারেন যা তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যেমনÑ নমরুদের বাহিনীর হয়েছিল। নবী সা: বলেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে তখন দুর্ভিক্ষ তাদের ঘিরে ধরবে। যখন সুদ, ঘুষ বৃদ্ধি পাবে, তখন ভয়ভীতি, সন্ত্রাস তাদের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে’ (মুসনাদে আমেদ)। নবী সা: আরো বলেছেন, ‘যখন সরকারি সম্পদকে দায়িশীল ব্যক্তি নিজের সম্পদের মতো আত্মসাৎ করবে, আমানতের খিয়ানত করবে, জাকাতকে জরিমানা মনে করবে, দ্বীনি স্বার্থ ছাড়া (শুধু দুনিয়া অর্জনের জন্য) জ্ঞানার্জন করবে, স্ত্রীর বশীভূত হবে, পিতা-মাতার অবাধ্য হবে, বন্ধুদের কাছে টানবে, পিতাকে দূরে সরাবে, মসজিদে বেশি শোরগোল হবে, খারাপ লোকেরা নেতৃত্ব পাবে, খারাপ নেতাদের মানুষ ক্ষতির ভয়ে সম্মান করবে, গানবাজনা বৃদ্ধি পাবে, পরবর্তী লোকেরা পূববর্তী লোকদের মন্দ বলবে, তখন তারা যেন অপেক্ষা করে উষ্ণ বায়ু, ভূমিকম্প, ভূমিধস, আকৃতি বিকৃতিসহ অন্যান্য বিপদের যা এমনভাবে একের পর এক আসবে, যেমনি কোনো মুক্তার মালার সুতা ছিঁড়ে গেলে দানাগুলো একের পর এক ঝরে পড়ে’ (তিরমিজি)। নবী সা: আরো বলেন, ‘যখন অশ্লীলতা বৃদ্ধি পায়, তখন প্লেগ-মহামারীর মতো এমন (নতুন) রোগব্যাধির বিস্তার করা হয়, যে রোগের নাম ও তাদের কেউ শুনেনি। অতীত জাতিদের ধ্বংসের ইতিহাস থেকে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত। আমরা যতই আধুনিক উপকরণের অধিকারী হইনা কেন, আল্লাহর অসীম ক্ষমতার কাছে এগুলো কিছুই না। বাতাস বাহ্যিকভাবে শক্ত কোনো জিনিস নয়, কিন্তু সে বাতাসকে ঝড় টর্নেডোতে পরিণত করে আল্লাহ তাকে ধ্বংসাত্মক শক্তিতে পরিণত করতে পারেন। সামান্য বন্যা যিনি দিতে পারেন, নূহ আ:-এর যুগের ন্যায় সারা পৃথিবী তলিয়ে দিলে কারো কি ক্ষমতা আছে তা প্রতিরোধের? সমুদ্রের পানিকে সুনামিতে পরিণত করে পুরো স্থলভাগ তলিয়ে দিলে কারো কি ক্ষমতা আছে তা রোধের? পৃথিবীর ভূভাগ নাড়িয়ে ভূমিকম্পের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে কেউকি তা কমাতে পারবে? যে আল্লাহ ভূগর্ভের অগভীর অংশে আর্সেনিক নামক বিষ দিয়ে আমাদেরকে সতর্ক করছেন, যে আর্সেনিকের এ পরিমাণ অতীতে ছিল না। সে আল্লাহ আরো গভীরে ভূগর্ভের সব স্তরের পানিতে আর্সেনিক ছড়িয়ে দিলে কেউকি তা রোধ করার ক্ষমতা রাখেন? অতীতে যে পরিমাণ বজ্রপাত হতো এখন তা অনেক বেড়ে গেছে, যদি আরো বহুগুণ বেড়ে যায় কেউ কি তা রোধ করতে পারবে? তাই আসুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টিতে সহায়ক সব উপকরণের বিকল্প চিন্তা করি, নিজের পরিবেশ নিজে সুন্দর রাখি, সে সাথে তাওবা করি, পাপ-দুর্নীতি থেকে বিরত থাকি, দুর্যোগ থেকে রক্ষায় আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করি।
লেখক : অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।