পুুণ্যময় মহররমের শিক্ষা

October 19 2019, 19:58

হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। ইসলামের তাৎপর্যপূর্ণ মাসগুলোর মধ্যে মহররম অন্যতম। মাসটি মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। পবিত্র কুরআনে এ মাসকে হারাম বা সম্মানিত মাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ মাসের এক দিকে যেমন রয়েছে ফজিলত, তেমনি অন্য দিকেও রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। তাই তো প্রতি বছরই আরবি এ মাস যখন মুসলমানদের কাছে উপস্থিত হয়, তখন তারা এ মাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি পরকালীন পাথেয় হাসিলের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
মহররম মাস ফজিলতপূর্ণ বিধায় পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জেনে রাখো! এই চারটি মাস বড় ফজিলত ও বরকতপূর্ণ। তোমরা এই মাসগুলোতে পাপাচার করে নিজেদের ওপর জুলুম করো না’ (সূরা তাওবা: ৩৬)। উল্লিখিত চার মাস বলতে মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ মাসকে বুঝানো হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাগ্রে হলো মহররম মাস। আল্লামা জাসসাছ বলেন, ‘এই চার মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোÑ যারা এ মাসগুলোতে ইবাদত-বন্দেগি করবে, রাব্বে কারিম তাদের বাকি আট মাস ইবাদত করার হিম্মত ও তাওফিক দান করবেন। এমনিভাবে যারা এ চার মাসে চেষ্টা-সাধনা করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারবে, তার জন্য অবশিষ্ট আট মাস গুনাহ থেকে বিরত থাকা সহজ হয়ে যাবে’ (আহকামুল কুরআন ১ : ৪৪৭)।
মহররম মাসের গুরুত্ব অত্যাধিক হেতু এ মাসে রয়েছে কিছু করণীয় আমল। যার মাধ্যমে বান্দার জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভ সহজ হয়। ঠিক তেমনি মানবজাতির চিরশত্রু শয়তানের কুমন্ত্রণায় তৈরি করেছে এ মাসে ইসলাম বিবর্জিত কাজ। তাই এ মাসে যেমনি নেক কাজ করতে হবে। অন্য দিকে, ইসলাম বিবর্জিত কাজ থেকে বিরতও থাকতে হবে।
মহররম মাসে করণীয় আমলের মধ্যে রয়েছে নফল রোজা রাখা। কেননা, রমজানের পরেই রয়েছে মহররমের মর্যাদা। হাদিস শরিফে আছে, ‘হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের পর রোজার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মাস হলো মহররম এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ তাহাজ্জুদের নামাজ’ (সহিহ মুসলিম : ২৮১২)। অন্যত্র এসেছে নবীজী সা: রমজানের রোজার পরই মহররম মাসের ১০ তারিখের অর্থাৎ আশুরার রোজার গুরুত্ব দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘আমি নবীজী সা:কে রোজা রাখার ব্যাপারে এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি, যেমনটি আশুরার রোজা ও রমজান মাসের রোজার ব্যাপারে দেখেছি’ (সহিহ বোখারি-১৮৬৭)।
১০ মহররমের রোজার গুরুত্বে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করা যায়, ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘নবী করিম সা: যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন মদিনার ইহুদিদের ১০ মহররম রোজা রাখতে দেখে তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এ দিন রোজা রাখো কেন?’ উত্তরে তারা বলল, এ দিনটি অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলদের তাদের শত্রু ফেরাউন থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা রোজার মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি। যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হজরত মূসা আ:-এর বিজয় দিবসের প্রশংসায় রোজা পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশি অধিকারী।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা: নিজে রোজা রাখলেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রা:কে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন’ (সহিহ বোখারি : ১৮৬৫)।
মহররমের রোজার গুরুত্ব অত্যধিক থাকায় রাসূলুল্লাহ সা: ১০ মহররম রোজা রেখেছেন। ইহুদি ও নাসারারা শুধু ১০ মহররম একদিন রোজা রাখত। তাই রাসূলুল্লাহ সা: তাদের অনুসরণ না করে ওই দিনসহ তার আগের অথবা পরের দিন রোজা পালন করেছেন। অতএব সুন্নত আমল হলোÑ ৯ ও ১০ মহররম অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা পালন করা। হাদিসে ইরশাদ হচ্ছেÑ ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো এবং ইহুদিদের বিপরীত করো। তোমরা আশুরার সাথে তার আগে একদিন বা পরে একদিন রোজা পালন করো’ (সুনানে তিরমিজি : ২১৫৪)।
আম্মাজান হজরত আয়েশা রা: বলেন, ‘জাহেলি যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা পালন করত। রাসূলুল্লাহ সা:ও তা পালন করতেন। মদিনায় হিজরতের পরও তিনি পালন করেছেন এবং লোকদেরকে তা পালন করতে বলেছেন।’ কিন্তু (দ্বিতীয় হিজরিতে) যখন রমজান মাসের রোজা ফরজ হলো, তখন তিনি বললেন, যার ইচ্ছা আশুরার রোজা পালন করতে পারো এবং যার ইচ্ছা তা পরিত্যাগ করতে পারো’ (সহিহ বোখারি-২০০২)।
আশুরার দিনে আরেকটি আমল হলো নিজ পরিবার-পরিজনকে উত্তম খানাপিনার ব্যবস্থা করা। যার কারণে তার পরিবারের জন্য আল্লাহ তায়ালা সারা বছর উত্তম খানাপিনার ব্যবস্থা করে দেবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিতÑ নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিন তার পরিবার-পরিজনের ওপর প্রশস্ততা (ভালো খাবারের ব্যবস্থা) করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সারা বছর প্রশস্ততা (ভালো খাবার) দান করবেন’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান-৩৭২৯)। হাদিসটির একাধিক সনদ রয়েছে। যার সবকটি দুর্বল। তবে সমষ্টিগত বিচারে হাদিসটি আমলযোগ্য। (হাফেজ সাখাবি, আল মাকাছিদুল হাসানাহ, পৃষ্ঠা-৬৭৪, আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, আল মানারুল মুনিফ পৃষ্ঠা- ১১২-১১৩)।
আশুরার দিন উল্লিখিত আমল ছাড়া যেহেতু অন্য কোনো আমল পাওয়া যায় না, তাই আমাদের দেশে আশুরার দিনে যেসব রেওয়াজ বা রুসম রয়েছে, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে খিচুড়ি পাকানো, শিয়াদের আবিষ্কৃত কু-প্রথা ও বিদয়াতগুলো যেমনÑ তাজিয়া (মাজারের সাদৃশ্য করে হজরত হুসাইন রা:-এর নকল কবর তৈরি করা), ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো, হায় হাসান-হায় হুসাইন! বলে মাতম করা, ছুরি মেরে নিজের বুক-পিঠ থেকে রক্ত বের করে বুক চাপড়ানো, শোকের পোশাক পরা ইত্যাদি। এসব করা যেমন নাজায়েজ, তেমনি এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাও নাজায়েজ।
মাতম (বিলাপ করে কান্নাকাটি) করার ব্যাপারে নবীজী সা: কঠোর হুঁশিয়ারি করেছেন। উম্মাহাতুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: বলেন, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যারা (মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গাল চাপড়ায়, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহেলিয়াত যুগের মতো চিৎকার দিয়ে কাঁদে, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’ (সহিহ বোখারি-১২৯৪)। অন্য হাদিসে এসেছে, আমি ওই ব্যক্তি হতে দায়িত্বমুক্ত, যে ব্যক্তি শোকে মাথা মুণ্ডন করে, উচ্চস্বরে কাঁদে ও কাপড় ছিঁড়ে’ (মিশকাত-১৭২৬)।
ওই দিন ঢাকঢোলসহ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান-বাজনা করাও পাপ। কেননা, গান-বাদ্যের আওয়াজ শোনা পাপ। সেসব বৈঠকে বসা ফাসেকি এবং তা থেকে স্বাদ উপভোগ বা উল্লাস করা ও আনন্দ করা কুফরি। (বায়যাবির ফতোয়ায়ে শামি ৬ : ৩৪৮-৩৪৯)।
লেখক : আলেম