নুসরাত হত্যা মামলার রায় আজ : যেভাবে হয়েছিল হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশে চলতি বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ফেনী জেলার সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে এ ঘটনা নিয়ে সমালোচনা ওঠে।
গত ৬ এপ্রিল নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। ১০ এপ্রিল ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত।
আগুন দেয়ার আগে যা ঘটেছিল :
নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সোনাগাজী মডেল থানায় ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিল নুসরাত।
গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার।
এর পরের দিন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দী দেয় নুসরাত জাহান।
মামলার পরপরই গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে।
নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইয়ের উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদারের সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে, নুসরাত হত্যা মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে, শ্লীলতাহানীর অভিযোগে কারাগারে থাকা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা কারাগারে বসেই নুসরাতকে হত্যার আদেশ দিয়েছিল, এমন অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়।
মজুমদার, এই হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত বলেও উল্লেখ করেন।
নুসরাতের গায়ে যেদিন আগুন দেয়া হলো :
নুসরাত হত্যার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেয়ার আগে এই তদন্তের প্রাপ্ত তথ্য গত ২৮ মে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল পিবিআই।
সেখানে পিবিআই জানায়, ৬ এপ্রিল সকালে শাহাদত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদরাসায় আসে এবং পরিকল্পনা মত যার যার অবস্থানে যায়।
শাহাদত হোসেন পলিথিনে করে আনা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে আনা গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়।
কামরুন্নাহার মনির তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে নয়টার দিকে বোরকা ও হাত মোজা পরিধান করে সেখানে অবস্থান নেয়।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা মতো উম্মে সুলতানা পপি গিয়ে নুসরাতকে বলেন তার বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে। একথা শুনে নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে।
দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায় পপি।
নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে ছাদে উঠলে কামরুন্নাহার মনি, শাহাদত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পিছনে ছাদে যায়। সেখানে তারা নুসরাতকে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে নুসরাত অস্বীকৃতি জানায়।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহাদত হোসেন শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ও পপিকে বলে নুসরাতের বোরকার মধ্য থেকে ওড়না নেয়ার জন্য।
পপি ওড়না নিয়ে জুবায়েরকে দেয়। জুবায়ের এক অংশ দিয়ে পা বাঁধে ও পপি হাত পেছনে বেঁধে ফেলে।
এরপর পপি, মনি ও শাহাদাত তাকে শুইয়ে ফেলে। পরে তাকে মুখ চেপে ধরে গিঁট দেয়া হয়। আর জাভেদ কালো পলিথিনে থাকা তেল গ্লাসে করে নিয়ে নুসরাতের শরীরে ঢেলে দেয়।
শামীমের ইঙ্গিতে জুবায়ের তার কাছে থাকা ম্যাচ থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়, তারপর সেখান থেকে সবাই চলে যায়।
আদালতে এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে অভিযুক্তরা।
যেভাবে সরে পড়ে অভিযুক্তরা :
নুসরাত হত্যার যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দিয়েছিল পিবিআই তার বরাত দিয়ে মিস্টার মজুমদার জানান, আগুন ধরানোর পর শম্পা ও মনি মনের থেকে বের হয়ে পরীক্ষার হলে পরীক্ষায় বসে।
আরেকজন পরীক্ষার্থী জাবেদও পরীক্ষার হলে যায়। শাহাদত হোসেন শামীমকে বোরকা দিয়ে যায়। সে মূল গেট দিয়ে বের না হয়ে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে বাড়িঘরে ঢুকে যায়। খুনিদের তিনজন পরীক্ষায় ও একজন বোরকা পুকুরে ফেলে বাড়িঘরে ঢুকে যায়। আর জুবায়ের বোরকা পরে ঘুরে মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে পাশে কৃষি ব্যাংকের সিঁড়িতে ওঠে বোরকা পলিথিনে নিয়ে বের হয়ে আসে।
এদিকে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে নুসরাতকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
চিকিৎসকরা জানান, আগুনে তার শরীরের কমপক্ষে ৮০% শতাংশই ঝলসে গিয়েছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার অর্থাৎ ১০ এপ্রিল মারা যায় নুসরাত।
এর আগে, ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে প্রধান আসামি করে আটজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও ৪-৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
নুসরাতের মৃত্যুর পর এই মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
অভিযুক্তরা সবাই কারাগারে :
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ডিআইজি, বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এ মামলার চার্জশিট ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে জমা দেয়া হয়। চার্জশিট গ্রহণ করে তা ওই দিনই নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
২৭ জুন, বাদি এবং নুসরাতের ভাই নোমানের প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়।
মোট ৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
মজুমদার বলেন, এ মামলায় ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
এ মামলায় অভিযুক্ত আসামীদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে এরা সবাই ফেনী জেলা কারাগারে রয়েছে।
আত্মহত্যা বলে প্রচার :
নুসরাত হত্যাকান্ডের ঘটনাটি শুরুতে গণমাধ্যমে আত্মহত্যা হিসেবে আসে। তবে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের দেয়া জবানবন্দীর পর এটি হত্যাকান্ড হিসেবে সামনে আসে।
এ বিষয়ে এরআগে পিবিআই কর্মকর্তা বনজ কুমার মজুমদার বিবিসি বাংলাকে জানান, এ হত্যাকান্ডে প্রতিটি লোকের প্রতিটি দায় তারা খুঁজে বের করেছেন।
“এদের ফাঁদে বহুজন পা দিয়েছিল যে আত্মহত্যা বলে চালানোর। এটি অনেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছিল।”
তিনি বলেন, “পরে যা বের হলো তাতে তারা যারা তদন্ত টিমে বা বাইরে ছিলাম তারা থ মেরে গেছেন – যে এমন ঘটনাও হতে পারে।”
ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন :
নুসরাত জাহানে রাফির শ্লীলতাহানির বিষয়ে একটি ভিডিও তৈরি ও সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ নিয়ে সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন সায়েদুল হক সুমন নামে এক আইনজীবী। মি. হক নানা সামাজিক ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভ করে একজন সোশ্যাল মিডিয়া সেলেব্রিটিতে পরিণত হয়েছেন।
২৬ মার্চ শ্লীলতাহানির পরের দিন নুসরাত, তার মা ও ভাইকে নিয়ে ফেনীর সোনাগাজী থানায় যায়। থানার ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাত এবং তার মা ও ভাইকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে যান বলে অভিযোগ।
মিস্টার হক জানান, নুসরাতের মা ও ভাইকে বের করে দিয়ে, নুসরাতকে বিব্রতকর প্রশ্ন করে সেটি ভিডিও করে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।
পরে ১১ এপ্রিল সেই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
হক এই ইস্যুটি ধরে গত ১৫ এপ্রিল সোনাগাজী থানার ওসির বিরুদ্ধে সাইবার আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। এর প্রায় একমাস পর ১৬ জুন শাহবাগ এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এর আগে, নুসরাতের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে ১০ এপ্রিল ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
নুসরাতের পরিবার তাদের অভিযোগে বলে, ওসি মোয়াজ্জেমের কাছ থেকে তারা যথাযথ সহায়তা পাননি। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত কাশিমপুর কারাগারে রয়েছে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।
এ পর্যন্ত হাইকোর্ট এবং ট্রাইব্যুনালে দুই বার জামিনের আবেদন করেছেন তিনি। তার জামিন হবে কিনা সে বিষয়ে হাইকোর্ট আগামী ৩ নভেম্বর রায় দেবেন বলে কথা রয়েছে।
আর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা শুরু হবে চলতি মাসের ৩০ তারিখ। গ্রেফতারের পর তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ভিডিও ফাঁস বিষয়ক মামলাটি বর্তমানে ডিজিটাল সাইবার ক্রাইম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
ন্যায়বিচারের আশা :
মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা করা হয় ২৭ মার্চ। এর পর পরই গ্রেফতার করা হয় তাকে।
অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতারের পরের দিন অর্থাৎ ২৮মার্চ সকালে বিচার চেয়ে এলাকায় মানববন্ধন করে নুসরাত জাহানের পরিবারের সদস্যরা।
এ মানববন্ধনের পরপরই একই দিনে গ্রেফতার হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে এলাকায় বিক্ষোভ করে কয়েক শ’ মানুষ।
সেসময় তারা অভিযোগ তোলে, অধ্যক্ষ সিরাজকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
২৯মার্চ আবারো অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে-বিপক্ষে আলাদা মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় বিপরীত পক্ষের লোকজনের সাথে মারামারিও হয়।
তবে ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মামলার বিষয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশের আগ পর্যন্ত এলাকায় নুসরাত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ আসেনি।
তবে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার পর ১১ জুন স্থানীয় আওয়ামীলীগের একাংশ এলাকায় বিক্ষোভ করে।
ফেনীর সোনাগাজীর স্থানীয় সাংবাদিক আবুল হোসেন রিপন বলেন, সোনাগাজী এলাকার ৬৫ ভাগ মানুষ ধর্ম ভিত্তিক নানা দলের সমর্থক।
আর এজন্যই শ্লীলতাহানির মামলায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দোলা গ্রেফতার হওয়ার পর এলাকার বেশিরভাগ মানুষ তার পক্ষে বিক্ষোভ করেছে। এমনকি হত্যার ঘটনা ও হত্যা মামলার পরও অনেক মানুষ রয়েছে যারা অধ্যক্ষকে সমর্থন করেন।
রিপন বলেন, এরপরেও স্থানীয় মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। স্থানীয় মানুষ আশা করে যে, এই মামলার রায় যেকোনো ধরণের প্রভাব মুক্ত হবে।
“মানুষের এখন আশা এ হত্যার ন্যায়বিচার হবে,” তিনি বলেন।
যে কারণে এই হত্যাকাণ্ড এত আলোচিত :
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকাণ্ড এতো বেশি আলোচিত হওয়ার পেছনে কাজ করেছে এ ঘটনার নৃশংসতার মাত্রা।
তারা বলছেন, একজন মানুষের শরীরের ৮০ ভাগের বেশি পুড়ে যাওয়ার পরও বেঁচে থাকার যে কষ্ট তা সেসময় মানুষকে নাড়া দিয়েছিল।
এছাড়া এর সাথে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক জড়িত থাকার ঘটনাও একে আলোচনায় রেখেছে।
সমাজবিজ্ঞানী সামিনা লুৎফা বলেন, “নুসরাতের সাথে নৃশংসতার যে ঘটনা ঘটেছিল তারপরও সে বেঁচেছিল। আর এ কারণেই তার প্রতি মানুষের সমবেদনা কাজ করেছে। যার কারণে এ ঘটনাটি এতো বেশি আলোচনায় এসেছে।”
“উনি তো আসলে জবানবন্দী দিয়ে গিয়েছিলেন, পুরো ব্যাপারটা একটা পরিকল্পনামাফিক হয়েছে, সেটা ধামাচাপা দেয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে, এই পুরো ব্যাপারটা মিলেই সেনসেশনটা তৈরি করেছে,” তিনি বলেন।
এছাড়া কোনো ঘটনাকে যখন মিডিয়া সেনসেশনে পরিণত করে তখন সেটার পেছনে ওই সময়ের এক ধরণের সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টিও কাজ করে বলে মনে করেন তিনি।
এ সময় অন্য কোনো বড় ঘটনা না ঘটাও এটি আলোচনায় থাকার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন সামিনা লুৎফা।
সূত্র : বিবিসি