দাম কমলেও পেঁয়াজ নিয়ে অস্বস্তি কমেনি

December 14 2019, 02:54

দাম কিছুটা কমলেও পেঁয়াজ নিয়ে সরকারের অস্বস্তি কমেনি। বিমানযোগে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে গিয়ে ভাড়াই পড়ে যাচ্ছে কেজিতে ১৫০ টাকা। বিশাল অঙ্কের ভতুর্কি দিয়ে সে পেঁয়াজ ৪৫ টাকা দামে বিক্রি করেও দেশবাসীকে খুশি করতে পারছেন না। ন্যায্যমূল্যের ট্রাকের সামনের লাইনও ছোট হয়ে আসছে। খাদ্য, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষিসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী প্রতিনিয়ত বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে ব্যস্ত রয়েছেন পেঁয়াজ নিয়ে সৃষ্ট অস্বস্তি দূর করার কাজে। বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল, ডাল, তেল, রসুন, আদা প্রভৃতি পণ্যও। তবে এত কিছুর মাঝেও জনমনে কিছুটা স্বস্তির সঞ্চার করেছে সবজির দাম। বাজারে বর্তমানে বেশির ভাগ সবজি পাওয়া যাচ্ছে সহনীয় দামে।

গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকার কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভালো মানের দেশী পুরনো পেঁয়াজ এখনো ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ কম হলে মুড়ি কাটা নতুন পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। পাতাসহ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। এ ছাড়া মিসর, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে ১০০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। বিদেশ থেকে আমদানি করা বেশির ভাগ পেঁয়াজ ন্যায্যমূল্যে বিক্রির জন্য টিসিবির পক্ষ থেকে কিনে নেয়ায় বাজারে দাম কমছে না বলে জানান বিক্রেতারা। তবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আশা, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে।

চিরচেনা দৃশ্য নেই : মাত্র কয়েক দিন আগেও রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পেঁয়াজ স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বিশাল লাইন থাকত। একজন ব্যক্তির কাছে দুই কেজির বেশি পেঁয়াজ বিক্রি করা হতো না। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। আবার শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেককে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। এ অবস্থা গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিরাজ করছিল। কিন্তু দুই দিন ধরে বাজারে দেশী পেঁয়াজের সরবরাহ শুরু হওয়ায় এর হাহাকার তুলনামূলকভাবে কমেছে। এখন ট্রাকভর্তি পেঁয়াজ থাকলেও ক্রেতা না থাকাটা অনেকটা অবিশ্বাস করার মতো ব্যাপার। গতকাল শুক্রবার বেলা আড়াইটায় রাজধানীর মতিঝিলে বলাকা ভাস্কর্যের সামনে টিসিবির একটি পেঁয়াজভর্তি ট্রাক থেকে সুমন মিয়া নামে এক যুবককে পথচারীদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, যত কেজি খুশি পেঁয়াজ নিয়ে যান। দামে কম, ভিড়ভাট্টা নেই। এমন সুযোগ আর পাবেন না। পেঁয়াজ কেনার জন্য তখন ক্রেতা ছিল মাত্র ৫ থেকে ৭ জন। তারা লাইন ছাড়াই ট্রাকের সামনে থেকে যত কেজি ইচ্ছা তত কেজি পেঁয়াজ নিয়ে যাচ্ছিলেন। বিক্রেতারা জানান, গত সপ্তাহ পর্যন্ত সরকারিভাবে বিক্রির জন্য প্রতিদিন মাত্র এক টন দেয়া হতো। এখন প্রতিদিন ট্রাক অনুযায়ী সর্বোচ্চ চার টন পেঁয়াজ দেয়া হচ্ছে। আগে প্রতিজনকে দুই কেজি করে দেয়া হলেও দুই দিন ধরে ৪ কেজি করে দেয়া হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়েছে : বাণিজ্যমন্ত্রী : পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের দায়ী করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ব্যবসায় মুনাফা কতটা করা যাবে, তার কোনো মানদণ্ড নেই। ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত যখন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলো, সে দিন সন্ধ্যায় ঢাকার বাজারে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ পেঁয়াজ তো আমদানি হয়েছে আগে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়েছে। তাদের যখন ধরা হয়, তারা বলেন, এখন সুযোগ পেয়েছেন বলে লাভ করেছেন। যখন লোকসান হয়, তখন তো কেউ খোঁজ নিতে আসে না। ঘাটতি মেটাতে উড়োজাহাজে করে পেঁয়াজ আমদানি করতে গিয়ে কেজি প্রতি ১৫০ টাকার মতো ভাড়া দিতে হয়েছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, মানুষের উপকারের জন্য সরকার এটি করেছে। তিনি মনে করেন, পেঁয়াজের দাম এমন একটা পর্যায়ে থাকা উচিত, যেখানে কৃষকের লোকসান হবে না। মানুষেরও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।

সিন্ডিকেট আছে : শিল্পমন্ত্রী : বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন বাজারকে অশান্ত করে তুলছে বলে দাবি করে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, দেশে অচল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা অর্জন করছে। বড় বড় দেশে এ প্রবণতাগুলো নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এগুলো বিদ্যমান। এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা এটা করে। অধিক মুনাফা করার জন্য তারা জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসা করতে চায়। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ব্যবসা আপনারা করবেন, এর লাভও আপনারা নেবেন। আপনারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে যান। সরকার সব ধরনের সুবিধা দেবে। তবে মানুষকে জিম্মি করবেন না। এটা হতে দেয়া যাবে না।

সিন্ডিকেট নেই : পরিকল্পনা কমিশন : পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেট কাজ করেনি দাবি করে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম বলেছেন, এবারের পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা তথ্যের ঘাটতির জন্য হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে পেঁয়াজের আমদানিকারক ২৫০ থেকে ৩২০ জন। এত লোক মিলে সিন্ডিকেট করা যায় না। আমাদের দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের উৎপাদন ১৮ লাখ টনের বেশি হবে না বলেও দাবি করেন তিনি। উৎপাদনের হিসাবের তারতম্য দেখা যায় সরকারের দু’টি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান থেকেও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলেছে, এবার পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। অন্য দিকে পরিসংখ্যান ব্যুরো বলেছে, উৎপাদন ১৮ লাখ টন।

নায়ক নাকি খলনায়ক : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ হয়েছে। আগের মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পেঁয়াজের কারণেই এবার মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মূল নায়ক এবার পেঁয়াজ, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। সামনে কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ উঠলেই মূল্যস্ফীতির হার কমে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তাদের মতে, পেঁয়াজ এখন খলনায়কের ভূমিকায়। কারণ পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি দুর্বিষহ করে তুলেছে ক্রেতাদের। সরকারের নানা পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও কমছে না পণ্যটির দাম।

পাবনায় কেজি ৬০ টাকা : পেঁয়াজের ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত পাবনায় পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। গতকাল পাবনা বড় বাজারে পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। সংবাদদাতা সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয় সুজানগর ও সাঁথিয়া অঞ্চলে। দেশের মোট উৎপাদিত দেশী পেঁয়াজের এক-তৃতীয়াংশ চাহিদা পূরণ হয় এ জেলার পেঁয়াজ দিয়ে। জেলার বিভিন্ন হাটে চলতি সপ্তাহের প্রথম দিকে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা মণ দরে। আর এই দুই দিনে পেঁয়াজের বাজার জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। বর্তমানে পাবনার হাটবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকা মণ। তবে দাম কমার কারণে পাইকারি ব্যবসায়ী ও সাধারণ কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

মাছ বাজারের হালচাল : মাছ বাজারে গতকাল শুক্রবার বড় সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। অন্য দিকে চিংড়ি আকারভেদে ৬০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়, দেশী রুই ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, চাষের শিং ৩৫০ থেকে ৪০০ এবং দেশী শিং ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, রূপচাঁদা ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, লাল কোরাল ৫৮০ থেকে ৭০০ টাকা, কাতাল ৩০০ টাকা, কৈ ৩০০ টাকা, তেলাপিয়া ১২০ থেকে ১৫০ টাকা এবং পোয়া ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়। অন্য দিকে প্রতি ডজন ব্রয়লার মুরগির ডিম ৯৫ থেকে ১০৫ টাকায়। আর সোনালি মুরগি ও হাঁসের ডিম ১৫০ টাকা, দেশী মুরগির ডিম ২০০ টাকায় বিক্রি হয়।

সবজিতে স্বস্তি : সবজি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খুচরা বাজারে গতকাল টমেটো বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা, গাজর ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শসা ৫০ থেকে ৭০ টাকা, ক্ষিরা ৫০ টাকা, ফুলকপির পিস ৪০ থেকে ৬০ টাকা, বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, মুলা ৩০ টাকা, বেগুন ৫০ থেকে ৬০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৪০ টাকা, লাউ ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শিম ৪০ থেকে ৬০ টাকা, আলু ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শালগম ৫০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, কচুমুখী ৬০ টাকা এবং মরিচ ৪০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। খিলগাঁও বাজারের বিক্রেতা মনির হোসেন জানান, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি সবজির দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা কমেছে। সরবরাহ বাড়লে আরো কমবে।

কৃষকের বাজার রাজধানীতে : এ দিকে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সেচ ভবনে সম্প্রতি চালু হয়েছে কৃষকের বাজার। সরকারি সহায়তায় মাঠ থেকে কৃষক নিজেই এসে রাজধানীবাসীর কাছে বিক্রি করছেন নিজের উৎপাদিত সবজি। সেচ ভবনের নিচতলায় প্রতি শুক্র ও শনিবার বসছে ব্যতিক্রমী এ হাট। নেই কোনো মধ্যস্বত্বভোগী, নেই ফরমালিন কিংবা বিষ। সবজির গুণগতমান নিশ্চিত করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সরকার কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে জাতীয় সবজি মেলার আয়োজন করছে। এই মেলার ধারণাকে কাজে লাগিয়ে এবার শুরু হয়েছে কৃষকের বাজার। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির একটি মূল চালিকাশক্তি কৃষি হলেও বিক্রয় সুবিধার অভাবে কৃষকরা বঞ্চিত থেকে যায়। তাই এই প্রক্রিয়াটি প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয় সরকার। পাশাপাশি পরিকল্পনায় ছিল নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়টিও। সাভার, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জ থেকে চাষিরা সবজি আনছেন এই সরকারি বাজারে। সবজি আনার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তাদের পরিবহন সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের ফায়দা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই দামও থাকবে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে।