চিনি কেন বিশ্বজুড়ে বড় একটি সমস্যা?

January 06 2020, 14:57

চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যান্সেটে ১৯৫টি দেশের ওপর একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় খাদ্য সংক্রান্ত কারণে মৃত্যুর হার বিশ্বে সবচেয়ে কম। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ শীর্ষক ঐ গবেষণাটির ২০১৯ সালের সংস্করণ এ বছরের শুরুর দিকে প্রকাশ করা হয়। ওই নিবন্ধে উৎসাহ দেয়া হয় যে, ‘ইসরাইলিদের মতো খাও।’

কিন্তু কেউ যদি সেটা করতে যায়, তাহলে তাকে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের নাগরিকদের চেয়ে খাবারে বেশি চিনি খেতে হবে।

‘ভয়াবহ ব্যাপার’

২০১৮ সালে একেক জন ইসরাইলি গড়ে ৬০কেজি করে চিনি খেয়েছেন, প্রতিদিনের হিসাবে যার পরিমাণ ১৬৫ গ্রাম। আন্তর্জাতিক চিনি সংস্থার (আইএসও) হিসাবে, এটা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।

”ইসরাইলে গড়ে একেকজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন চা চামচের আকারের ৩০ চামচের বেশি চিনি খেয়ে থাকে-যা আসলে ভয়াবহ একটা ব্যাপার”, বলছেন অধ্যাপক ইতামার রায, ইসরাইলের ডায়াবেটিক জাতীয় কাউন্সিলের প্রধান এবং এই রোগের ব্যাপারে একজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চিনি খাওয়া দেশের তালিকার শীর্ষ পাঁচের মধ্যে আরো আছে মালয়েশিয়া, বার্বাডোস, ফিজি এবং ব্রাজিল। আর সবচেয়ে কম চিনি গ্রহণকারী দেশের মধ্যে আছে উত্তর কারিয়া, যে দেশে প্রত্যেক নাগরিকের গত চিনি খাওয়ার হার ২০১৮ সালে ছিল ৩.৫ কেজি।

কিন্তু তাদের তুলনায় প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রত্যেক নাগরিকরা বছরে গড়ে চিনি খেয়েছেন ৩০.৬ কেজি করে। যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য সংক্রান্ত রোগের অনেক সমস্যা থাকার পরেও, দেশটির নাগরিকরা গড়ে ৩১.১ কেজি করে চিনি খেয়েছেন। তবে এই পরিমাণ চিনি খাওয়ার পরই শীর্ষ বিশটি দেশের নীচেই রয়েছে তারা।

মোট পরিমাণের হিসাবে বেশি চিনি ব্যবহার করেছে ভারত। ২০১৮ সালে এই পরিমাণ ছিল ২৫.৩৯ মিলিয়ন মেট্রিকটন- যা পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্যবহার করা চিনির চেয়েও বেশি।

‘বেশি চিনি খাওয়ার কারণ’

চিনি ব্যবহারের এই পরিসংখ্যান এটা বলছে না যে, মানুষজন শুধুমাত্র খাবার বা পানীয়তে চিনি খাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষায় বলা ‘ফ্রি সুগার’-যা বিভিন্ন খাবার প্রস্তুতের সময় চিনি যোগ করা হয় অথবা ফলের জুসের মতো যেসব খাবারের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই উচ্চ মাত্রার চিনি যুক্ত থাকে।

আইএসও-র তথ্য অনুযায়ী, এসব কিছু যোগ করলে ২০০১ সালের চিনি খাওয়ার হার ১২৩.৪ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে ১৭২.৪ মিলিয়ন টনে। যার মানে হলো, বিশ্বে গড়ে জনপ্রতি ২২.৬ কেজি করে চিনি খাওয়া হচ্ছে।

ব্যাপকহারে চিনির ব্যবহার

কিন্তু কেন আমরা বেশি পরিমাণে চিনি খাচ্ছি? এর অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে যে, চিনির দাম বরাবরই কম এবং আমাদের শরীরের শক্তির অন্যতম সহজলভ্য উৎস এটি। জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, ভারতে মানুষের খাওয়া খাদ্যের মধ্যে চিনি একটি অপরিহার্য উপাদান এবং গরীব মানুষের শক্তি সঞ্চয়ের সবচেয়ে সস্তা উৎস।

দেশটিতে চিনি খাওয়ার হার সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রাতারাতি বেড়ে গেছে। ষাটের দশকের শুরু থেকে নব্বুই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চিনির ব্যবহারের পরিমাণ বছরে ২.৬ মিলিয়ন টন থেকে ১৩ মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে।

গত পাঁচ দশক জুড়ে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের খাদ্যের মধ্যেই চিনি যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে চিনি-এটি খাবারের ঘ্রাণ বাড়ানো অথবা বেশিদিন টিকিয়ে রাখার কাজে সহায়তা করে। অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, আমাদের অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার কারণে বিশ্বে স্থূলতার সমস্যাও মহামারি আকারে বেড়ে যাচ্ছে।

কম চিনি খাওয়ার হার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে চিনি খাওয়ার নির্ধারিত মাত্রা কমিয়ে দেয়। সংস্থাটি পরামর্শ দিয়েছে যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং শিশুর প্রতিদিন যতটুকু শক্তি সঞ্চয়ী খাবার গ্রহণ করেন, সেখানে চিনির পরিমাণ ১০ শতাংশের কম হওয়া উচিত।

সংস্থাটি বলছে, এই পরিমাণ যদি পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনা যায়- প্রতিদিন গড়ে ৬ চা চামচ বা ২৫ গ্রাম পরিমাণ – তাহলে স্বাস্থ্যের জন্য বাড়তি অনেক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ পরিচালক ভিক্টোরিয়া টেইলর বলছেন, ”এটা পরিষ্কার যে, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষগুলো চিনি খাওয়ার হার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিচ্ছে। তবে এখনো সব বয়সের এবং সব আয়ের মানুষের মধ্যে চিনি খাওয়ার হার অনেক বেশি।”

করারোপ

এসব কারণে বেশ কয়েকটি দেশ শুধুমাত্র চিকিৎসা পরামর্শের বাইরে গিয়ে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। গত কয়েক বছরে বিশটির বেশি দেশ চিনি দিয়ে তৈরি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, যার বেশিরভাগই তরল পানীয়। এ মাসের শুরুর দিকে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে উঁচু মাত্রার চিনিযুক্ত তরল পানীয়ের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করেছে সিঙ্গাপুর। সামনের বছর থেকে সেটি কার্যকর হবে।

”আমাদের দ্রুত বয়স্ক হতে থাকা জনসংখ্যা এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার ফলে একটি অস্থিতিশীল ও ব্যয়বহুল, কিন্তু দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করছে। সেটা ঠেকাতে আমাদের এখনি পদক্ষেপ নেয়া উচিত”, গত অক্টোবরে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী এডউইন টঙ।

তবে চিনি যুক্ত তরল পানীয়ের ক্ষেত্রে এসব ব্যবস্থা হঠাৎ করে নেয়া হয়নি। এগুলোয় চিনির পরিমাণ অনেক বেশি এবং পুষ্টির পরমাণ কম। কিন্তু এসব তরল পানীয় প্রায় সব দেশেই ব্যাপক পরিমাণে খাওয়া হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৫৫ মিলিলিটার অরেঞ্জ জুসে প্রায় ১১চা চামচ পরিমাণের চিনি থাকে।

অনেক গবেষণায় বার বার দেখা গেছে যে চিনিযুক্ত পানীয়ের সঙ্গে ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। সেই সঙ্গে টাইপ টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এমনকি তাড়াতাড়ি মৃত্যুর আশঙ্কাও রয়েছে।

এককভাবে দোষারোপ

তবে অনেকে মনে করেন, চিনির অযথা বদনাম করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চিনি সংস্থার প্রেসিডেন্ট হোসে অরিভ বিবিসিকে বলেছেন যে, মানুষের খাওয়া খাদ্যের মধ্যে আরো অনেক অস্বাস্থ্যকর খাবার থাকলেও এখানে চিনিকে এককভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে।

”চিনির বদনাম দেয়া হচ্ছে, কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ঐতিহাসিকভাবেই এটি শক্তি সঞ্চয়ের একটি মৌলিক উৎস। এমনকি মায়ের বুকের দুধেও চিনি রয়েছে। স্থূলতার সমস্যার জন্য এককভাবে শুধুমাত্র চিনিকে দোষারোপ করলে চলবে না। সেজন্য দায়ী আরো অনেক উপাদান রয়েছে, যেমন শারীরিক পরিশ্রমের চর্চা কমে যাওয়া এবং মানুষের পুরো খাদ্যাভ্যাস।”

”আমরা এ ব্যাপারেও পরিষ্কার যে, কোন কিছুর বেশি খাওয়া কারো জন্যই ঠিক নয়,” অরিভ যোগ করেন।

‘ভেঙ্গে পড়া খাদ্য ব্যবস্থা’

গবেষক ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা অ্যাকশন সুগার চিনির ওপর আরো বেশি কড়াকড়ি আরোপ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দেন দরবার করছে। সংস্থাটির একজন পুষ্টিবিদ হোলি গ্যাব্রিয়েল বলছেন, সমস্যার একটি অংশ হলো চিনি।

”স্থূলতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো স্থূলতার পরিবেশ এবং ভেঙ্গে পড়া খাদ্য ব্যবস্থা। এ কারণেই নানা ধরণের অনেক পদক্ষেপ নেয়া উচিত, যার মধ্যে শুল্ক আরোপ থেকে শুরু করে বাধ্যতামূলক বিকল্প কর্মসূচী নেয়া উচিত।”

দীর্ঘমেয়াদি শুল্কারোপের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইএসও নির্বাহী অরিভ, তাই বলে খাবার ও পানীয় শিল্পে চিনি ব্যবহারের সমালোচনা বন্ধ করেন নি। স্বাদ বাড়ানোর বাইরে প্রক্রিয়াজাত খাবারে চিনি ব্যবহারের অন্য কারণ রয়েছে- আরো অনেক জিনিসের মতো এটি পণ্যের জীবনকাল বাড়িয়ে দেয়।

”শুল্কারোপ করার ফলে এ পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে যে, সরকারের বাড়তি আয়ের উৎস হবে। কিন্তু এই বিতর্কে খাদ্য শিল্পের অংশ নেয়া উচিত এবং তাদেরও ভূমিকা রাখা উচিত।”

বেশ কয়েকটি দেশে ঠিক এই কাজটি করেছে খাদ্য ও পানীয় কোম্পানিগুলো। গত ডিসেম্বর মাসে জার্মানির বেশ কয়েকটি বড় খাদ্য কোম্পানি সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে যে, তারা ২০২৫ সালের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে চিনি ও লবণের পরিমাণ কমিয়ে আনবে। তরল পানীয়ে চিনি ব্যবহারের পরিমাণ তারা ১৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায়।

কিন্তু শুল্কারোপের কি অবস্থা? এটি কি কাজ করবে?

নিউজিল্যান্ডের অটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, চিনিযুক্ত তরল পানীয়ের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলে সেধরণের খাবার ক্রয় ও খাওয়ার হার গড়ে ১০ শতাংশ কমে যায়। তা সত্ত্বেও লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষকরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে বিস্কুট, কেক আর মিষ্টির ওপর শুল্ক আরোপের ফলে স্বাস্থ্যগত উল্লেখযোগ্য উপকারিতা পাওয়া যাবে।

অনেক দেশে এ জাতীয় পদক্ষেপের ফলে খাদ্য ও পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্ক এড়াতে নতুন করে তাদের পণ্য তৈরি শুরু করেছে। যেমন যুক্তরাজ্যে এপ্রিল ২০১৮ থেকে পানীয়ের মধ্যে চিনির ব্যবহার ২৮.৮ শতাংশ কমে গেছে। যেহেতু বেশিরভাগ দেশে চিনি শুল্ক সাম্প্রতিক একটা ব্যাপার, তাই এর ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ যৌথভাবে গবেষণা করেছে যে, এ জাতীয় খাদ্য ও পানীয়ের ২০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির ফলে কি ঘটতে যাচ্ছে। ফলাফল? চিনিযুক্ত খাদ্য-পানীয়ের মূল্য বৃদ্ধির ফলে সব শ্রেণীর মানুষের বছরে গড়ে ১.৩ কেজি করে ওজন কমবে। তবে তারা এটাও দেখতে পেয়েছেন, আরেকবার এ ধরণেরও দাম বাড়লেও বছরে ওজন কমবে মাত্র ২০৩ গ্রাম।

হালকা খাবারে কর

”ব্রিটিশ সরকার একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে যে, কীভাবে বাস্তবতার সাথে মিল রেখে নীতি গ্রহণ করতে হয়। ব্রিটিশরা চিনি বা তরল পানীয়ের তুলনায় হালকা খাবারের মাধ্যমে অনেক বেশি চিনি খেয়ে থাকে,” বলছেন গবেষণার প্রধান লেখক পাউলিন স্কেহিলবেক।

তিনি এবং তার সহকর্মীরা ধারণা করেন যে, ‘হালকা খাবারের ওপর কর’ ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে স্থূলতার হার বছরে ২.৭ শতাংশ হারে কমিয়ে দিতে পারে।

”আমাদের ক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার যে, শুল্কারোপ কাজ করছে, যদিও স্থূলতা মোকাবেলা এবং স্বাস্থ্যের পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য একমাত্র কোন পন্থা নেই। তবে যেটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, তা হলো এই সমস্যা মোকাবেলার অন্যতম বড় অনুষঙ্গ হলো যতটা এ জাতীয় খাবার যতটা সম্ভব কম খাওয়া।” সূত্র : বিবিসি।