কুরআন ও ধর্মীয় বই ছাপানোর নামে ১৭ কোটি টাকা লোপাট
ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা) ধর্মীয় বই ছাপানোর নামে ১৭ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষায়।
পবিত্র কুরআনের কপি কম ছাপিয়ে, আরবি ভাষা শিক্ষার টিচার্স গাইড ও উগ্রবাদবিরোধী বই না ছাপিয়ে, ইফার মহাপরিচালক (ডিজি) লিখিত বইয়ের রয়্যালিটির নামে এই টাকা তছরুপ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ কপি কুরআন শরিফ কম ছাপিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয় প্রায় দুই কোটি টাকা।
প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারিক কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজল ২০০৯ সাল থেকে ইফার ডিজির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আগামী ৩১ ডিসেম্বর তার সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে।
গত ৯ জুলাই ’১৯ থেকে ১০ অক্টোবর ’১৯ পরিচালিত এই নিরীক্ষার খসড়া রিপোর্টটি গত ২৪ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ে এগ্রিড মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং অডিট সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অডিট টিমের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, ইফার বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগের সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায়নি। তবে ফেরত দেয়া অর্থ সমন্বয় করা হয়েছে। আরো কিছু ফেরত পেলে তাও সমন্বয় করা হবে। ইতোমধ্যেই এগ্রিড মিটিং হয়ে গেছে। ওখানেই খসড়া রিপোর্টটিই চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ছোটখাট কিছু পরিবর্তন করে চূড়ান্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া প্রক্রিয়াধীন।
রিপোর্টে অনিয়মের পুরো টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত প্রদান এবং অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
নিরীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদনে ইফার ১৩৪টি খাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগের ব্যাপারে ইফার জবাব চাওয়া হয়। এরপর ইফা ডিজির পক্ষ থেকে কয়েক দফায় প্রায় ৮২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়াসহ জবাব দেয়া হয়। জবাবগুলো আবার খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইফার কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে বসে অডিট টিম এবং সেটি চূড়ান্ত করা হয়। এতে অনিয়মের খাতের সংখ্যা কমে আসলেও অনিয়মের টাকার অংকে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কুরআন শরিফ না ছাপিয়ে ২ কোটি টাকা লোপাট : ইফার মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের অধীন কুরআন মুদ্রণের ক্ষেত্রে কার্যাদেশে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে ৯৯ হাজার ৬৮০ কপি কম ছাপিয়ে পুরো বিল নিয়ে নেয়া হয়।
২০১৭-১৮ আর্থিক সালে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮০ কপি কুরআন সরবরাহের জন্য ইফার প্রেসকে সরাসরি কার্যাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু প্রেস থেকে ৫ লাখ কপি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮০ কপি মুদ্রণের বিল বাবদ ১১ কোটি ৬০ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টাকা পরিশোধ করা হয়। এতে ১ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। এই আত্মসাতের বিষয়ে ইফা সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় নিরীক্ষার সুপারিশে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং আত্মসাতের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।
আরবি শিক্ষার গাইড বের না করে ১০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ : গণশিক্ষা প্রকল্পের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরবি শিক্ষাবিষয়ক টিচার্স গাইড, অনুশীলন ও ড্রয়িং খাতা ইত্যাদি মুদ্রণ বাবদ ১০ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। অথচ এই ধরনের কোনো গাইড ও সামগ্রী ছাপানো হয়নি।
অবশ্য ইফার পক্ষ থেকে লিখিত জবাবে এসব সামগ্রী ছাপানোর দাবি করা হলেও অডিট টিমের চাহিদার প্রেক্ষিতে ইফার উক্ত প্রকল্পের সহকারী পরিচালক (অর্থ) এমন কোনো গাইড ও সামগ্রী ছাপানো হয়নি মর্মে জানায়। ফলে অনিয়মের এই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে অডিট অফিসকে জানাতে বলা হয়েছে রিপোর্টে।
উগ্রবাদবিরোধী বই না ছাপিয়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা উত্তোলন : সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম শীর্ষক কর্মসূচির পুস্তক মুদ্রণ ও বাঁধাই বাবদ ৩ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হলেও পুস্তক মুদ্রণের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি ইফা।
‘সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম’ নামক পুস্তকটি মুদ্রণের জন্য ২০১০-১১ অর্থ বছরে ২ লাখ ২০ হাজার কপি এবং ২০১১-১২ অর্থ বছরে ২ লাখ ৮০ হাজার কপি মুদ্রণের কার্যাদেশ হয়। এই কার্যাদেশ অনুযায়ী বিল গ্রহণের নথিপত্র পাওয়া গেলেও বই ছাপানো বা প্রেরণের কোনো রেকর্ড দেখাতে পারেনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এই অভিযোগের জবাবও দেয়নি ইফা। ফলে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলেছে অডিট টিম।
উগ্রবাদ প্রতিরোধ কর্মসূচির ৩০ লাখ ৫৩ হাজার টাকার কোনো হদিস নেই : উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে ইফা প্রেসকে প্রদানের নামে ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ৭২৯ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।
২০১১-১২ অর্থ বছরে এই টাকা স্থানান্তরের কথা বলা, প্রমাণ পাওয়া গেলেও এই টাকার কোনো হিসাব দেখাতে পারেনি ইফা। এ ছাড়া উগ্রবাদবিরোধী প্রচারণার টাকা ইফা প্রেস খাতে কেনো স্থানান্তর করা হয়েছে সেই বিষয়েও কোনো জবাব পায়নি অডিট টিম। এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগেরও কোনো জবাব দেয়নি ইফা। ফলে অনিয়মের অভিযোগটি সরাসরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে উক্ত টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।
বইয়ের রয়্যালিটির নামে বেআইনিভাবে ১৫ লাখ টাকা গ্রহণ : ইফা ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজল ও প্রকল্প পরিচালক ড. সৈয়দ এমরান ২০১৪-১৮ অর্থবছরে নিয়ম বহির্ভূতভাবে মোট ১৪ লাখ ৯২ হাজার ৭৪১ টাকা রয়্যালিটি গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ডিজি গ্রহণ করেছেন ১০ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৫ টাকা এবং অপর পরিচালক নিয়েছেন ৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৬৬ টাকা। সামীম আফজাল তার নামে লিখিত ১৩টি ও ড. এমরান ১২টি বইয়ের বিপরীতে এই টাকা গ্রহণ করেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ধরনের রয়্যালিটি বা সম্মানী গ্রহণ বন্ধের ব্যাপারে সরকারের আদেশ রয়েছে। এ ছাড়া এমন সম্মানী গ্রহণের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু এক্ষেত্রে এসবের কিছুই মানা হয়নি। এ ব্যাপারে ইফার জবাব প্রত্যাখান করে উক্ত টাকা সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তার কাছ থেকে আদায়ের মতামত দিয়েছে অডিট অধিদফতর।