এক অঙ্কের সুদ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জে পড়বে ব্যাংক

December 26 2019, 04:49

ব্যাংকঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ ৯ অঙ্ক কার্যকর করতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে ব্যাংকগুলো। বিভিন্ন মেয়াদে যাদের কাছ থেকে আমানত নেয়া হয়েছিল তাদের সুদহার কমানো যাবে না। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী দিন শেষে তাদের সুদাসলে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু নতুন পুরনো মিলে ১ জানুয়ারি থেকেই উৎপাদনমুখী সব শিল্পঋণের সুদহার ৯ অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। এতে আমানতের সুদহার না কমাতে পারলেও ঋণের সুদহার কমে যাওয়ায় যে লোকসানের মুখে পড়বে ব্যাংকগুলো তা সমন্বয় করা কঠিন হয়ে যাবে।

কথাগুলো বলেছেন একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এমডি জানিয়েছেন, মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে ঋণের সুদহার। বিনিয়োগ চাহিদা বেশি হলেও সে অনুযায়ী টাকার প্রবাহ কম থাকলে ঋণের সুদহার বেড়ে যাবে। আবার টাকার প্রবাহ বেশি থাকলে আর সে অনুযায়ী ঋণের চাহিদা কম থাকলে ঋণের সুদহার এমনিতেই কমে যাবে। গত দেড় বছর আগে নয়-ছয় ঘোষণা করায় তখন থেকেই আমানত প্রবাহ কমতে থাকে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো নানাভাবে আমানতের সুদহার কিছুটা কমিয়ে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। ঋণের সুদহার কমে যাওয়ায় সাধারণ আমানতকারীরা টাকা ব্যাংকে না রেখে বেশি মুনাফার জন্য সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন খাতে রাখে। এতে ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবাহ কমে যায়। কোনো কোনো ব্যাংকে টাকার সঙ্কট তীব্র হওয়ায় তারা আবার সুদহার বাড়াতে থাকে। অর্থাৎ দুই-একটি ইসলামী ব্যাংক বাদে আর সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকই আমানতের সুদহার ৯ শতাংশের উপরে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়িয়ে ১০ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত করেছে। এমনি পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

অপর একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে নতুন পুরাতন মিলে উৎপাদনমুখী শিল্প ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু নতুন ঋণের ক্ষেত্রে যতটা সমস্যা দেখা না দেবে, তার চেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দেবে পুরনো ঋণের সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে। কারণ, অতীতে যাদেরকে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল, সেটাতো অতীতের আমানতের অর্থ দিয়ে বিতরণ করা হয়েছিল। যেমন, তিন বছর আগে একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়েছিল। পাঁচ বছর পরে তাকে সুদাসলে ২০০ টাকা ফেরত দিতে হবে। ওই ১০০ টাকার মধ্যে এসএলআর ও সিআরআর সংরক্ষণ করার পর ৮১ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বার্ষিক ১২ শতাংশ সুদে। ইতোমধ্যে তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আর দুই বছর পর আমানতকারীর সুদে আসলে ২০০ টাকা ফেরত দিতে হবে। কিন্তু এখন তিন বছর আগে যাকে ১৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী ওই ঋণের সুদহার সরাসরি ৪ শতাংশ কমিয়ে ৯ শতাংশ করতে হবে। অথচ দেখা গেছে ব্যাংক ১০ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ করেছিল। এতে শুধু গ্রাহককেই সুদ পরিশোধ করতে হবে ১ শতাংশ লোকসান দিয়ে। আর পরিচালন ব্যয় যোগ করলে আরও তিন শতাংশ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা ৩ শতাংশ কমাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সুদহারে ৪ শতাংশ লোকসান দিতে হবে। এটা যদি ১০ হাজার কোটি টাকা হয়, তাহলে ৪ শতাংশ হারে একটি ব্যাংকের সুদহারে লোকসান হবে ৪০০ কোটি টাকা। আর ২ শতাংশ হলে লোকসান হবে ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে এক চতুর্থ ভাগ যদি শিল্প ঋণ হয় তাহলে মোট শিল্প ঋণের পরিমাণ হবে আড়াই লাখ কোটি টাকা। আর এ আড়াই লাখ কোটি টাকায় ব্যাংক খাতকে রাতারাতি লোকসান দিতে হবে ৪ শতাংশ হারে ১০ হাজার কোটি টাকা আর ২ শতাংশ হারে লোকসান দিতে হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। এত বড় লোকসানের ধকল সামলানো বর্তমানে ব্যাংক খাতের নেই।

ওই এমডি জানিয়েছেন, এরপরেও কর্তার ইচ্ছায় কর্ম অর্থাৎ যে রকম নির্দেশনা আসে তাই করতে হবে- এতে ব্যাংকিং খাতের কী পরিস্থিতি হয় তা সময়েই বলে দেবে।

অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিলে ব্যাংক খাতের জন্য সুবিচার করা হবে না। কারণ, পুরনো শিল্প ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট নামিয়ে আনলে যে পরিমাণ লোকসান হবে, ব্যাংক খাত ওই লোকসানের ধকল কিভাবে কাটিয়ে উঠবে তারও পথ দেখালে ব্যাংক খাতের জন্য সুবিচার করা হবে। এটা না হলে ব্যাংকগুলোর সমস্যা দেখা দিলে পুরো অর্থনীতিতেই সমস্যা দেখা দেবে। এতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা ভেঙে পড়বে। এতে কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ উৎপাদনমুখী শিল্প ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর করার অনুমোদন দিয়েছে। এটা কার্যকর হবে ১ জানুয়ারি থেকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আজ সার্কুলার জারি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।