আল্লাহকে স্মরণ করুন
‘শতবর্ষ পরে কে পড়িছ মোর কবিতাখানি কৌতুহলভরে’।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১০০ বছর পর তার কবিতাপড়–য়াদের কথা স্মরণ করছেন। তার চিন্তার সাথে, অনুভূতির সাথে এক সূক্ষ্ম মিলনের সেতুবন্ধন তৈরি করার উদগ্র বাসনা জেগেছে মনে। নিজের কথা, অনুভূতি এবং পরিবেশের মধ্য দিয়ে তার পাঠকের সর্বসত্তায় বিচরণ করতে চেয়েছেন। এ আকাক্সক্ষা সব মানুষের। কেউ সন্তানের মধ্যে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান, কেউ শিল্পকর্ম করে তার শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, কেউ লেখনীর মাধ্যমে তার অনুভূতি-আবেগকে পৃথিবীময় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চান। এই যে নিজকে, নিজের সৃষ্টিকে, নিজের ইচ্ছাকে পরবর্তীতে পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছাÑ এটা আমরা সর্বশক্তিমান শ্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকেই পেয়েছি। কেননা, তিনি বলেছেনÑ
‘অতএব, যখন আমি তার (আদম আ:) সৃষ্টিকার্য সম্পূর্ণ করব এবং তাতে আমার (তরফ থেকে) রুহ ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা সবাই তার সম্মুখে সেজদায় পতিত হবে’ (সূরা ছোয়াদ, আয়াত নং-৭২)।
আল্লাহ তায়ালা নিজ তরফ থেকে রুহ ফুঁকে দেবেন। অর্থাৎ সৃষ্টির মধ্যে নিজের অনুভূতিকে আবেগকে পৌঁছে দেয়া, ছড়িয়ে দেয়ার এই যে আকাক্সক্ষাÑ এটা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছ থেকে মানুষ পেয়েছে। আদেশ, নসিহত, উপদেশ যা জ্ঞানী-বুজুর্গরা দিয়ে থাকেন তা আল্লাহ তায়ালারই রুহ ফুঁকে দেয়ারই তাছির। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়ে সেই কাজটিই করে গেছেন। তাঁর সৃষ্টির কল্যাণের জন্য বিভিন্ন বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বলেছেনÑ
‘অতঃপর যদি তোমাদের কাছে আসে আমার পক্ষ থেকে কোনো হেদায়েত, তবে যারা আমার অনুসরণ করবে আমার ওই হেদায়েত, তাদের ওপর কোনো ভয়ও আসবে না এবং এরা সন্তপ্তও হবে না। আর যারা কুফরি করবে এবং মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, আমার আহকামকে তারা হবে দোজখি, তারা তাতে অনন্তকাল থাকবে’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত নং-৩৮-৩৯)।
আল্লাহ তায়ালা মানুষ বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সাথে দিয়েছেন ইচ্ছাশক্তি। তারপর আছে শরীর-মন সর্বত্র বিচরণকারী আজন্ম শত্রু ইবলিশ। এত সবের মাঝে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তার নসিহতসংবলিত বাক্যাবলিও পাঠিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমার আদেশগুলো মানো। সফল হবে। আর যদি না মানো তবে অনন্তকাল অন্ধকার আজাবে নিপতিত হবে’। বলেছেন, ‘আমার কথা মানো, ইহকাল-পরকালে শান্তি পাবে’।
এই যে আল্লাহ তায়ালা তার অনুভূতিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার আকুতি, তার সৃষ্ট মানুষের মঙ্গলের জন্য আকুলতা, অমঙ্গল চিন্তায় নিরন্তর মঙ্গলের আহ্বান, প্রতিনিয়ত তওবার আহ্বান, ক্ষমার ঘোষণা, বেহেশতের অনাবিল শান্তির বর্ণনা, দোজখের ভয়াবহ শাস্তির আগাম বার্তা প্রেরণÑ এ সবই তাঁর মহান সত্তার বৈশিষ্ট্য যা মানুষের মাঝেও বর্তমান।
গুরুজনেরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এমনই বলে থাকেন। কেউ শোনে কেউ শোনে না। শুনলে গুরুজনেরা সন্তুষ্ট হন। ভালো লাগে। শান্তি পান। আর না শুনলে অসন্তুষ্ট হন, কষ্ট পান। আর গুরুজনেরা বা শুভাকাক্সক্ষীরা তাদের কথা না শোনার কারণে পরবর্তীদের যে কষ্টকর অবস্থা উপস্থিত হয়, তা দেখে মর্মাহত হন। কিন্তু তাদের করার কিছুই থাকে না। কেননা, এটা তাদের হাতের কামাই।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অনুভূতি আরো বেশি। তিনি অত্যন্ত ভালোবেসে মানবকুল সৃষ্টি করেছেন। আর মানবের সেবা করার জন্য সমস্ত মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। সেই মানবকুল যদি মহান রাব্বুল আলামিনের কথা না শোনে এবং তাঁকে অস্বীকার করে তা হলে তাঁর কষ্টের এবং অসস্তুষ্টির সীমারেখা আমরা আঁকতে পারব না।
কবির মনে যদি শতবর্ষ পরের মানুষের হৃদয়ে থাকার আকুতি থাকে, তবে আদম আ: থেকে কেয়ামত পর্যন্ত শেষ মানুষটির কাছে কেন মহান রাব্বুল আলামিনের বাণী পৌঁছে দেয়ার আকুতি থাকবে না? আর তিনি চাইতেই পারেন শেষ দিন পর্যন্ত মানুষ তাঁর কথা স্মরণ করুক।
কবির কবিতা যদি পরবর্তী ১০০ বছর পরের মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়ে মহাসমারোহে সে সময়টাকে উপলব্ধি করার উৎসব পালন করে থাকে, তবে মাহান রাব্বুল আলামিনও তো চাইতে পারেন; আমরাও পূর্ণ উদ্যমে সৃষ্টিকর্তার আদেশ-নিষেধ পালনের মহা উৎসব পালন করি। তিনি অবশ্যই তা চাইতে পারেন। কারণ তিনি কবিরও স্রষ্টা।
মহান রাব্বুল আলামিন যে অনন্তকালের সুখের ঠিকানার সন্ধান দিয়েছেন, তা মানুষ বিশ্বাস করুক এবং সে মতো কাজ করুক। স্রষ্টার বিশ্বাসে বিশ্বাসী হোক প্রতিটি মানুষ। পৃথিবীতে সুখী হোক; পরকালেও অনন্তকালের সুখ ভোগ করুক। আল্লাহ তায়ালা আহ্বান করেছেন সমস্ত মানবমণ্ডলীকে। বলেছেনÑ
‘কে আছো যে, আল্লাহ তায়ালাকে উত্তম কর্জ দান করবে? অতঃপর আল্লাহ তায়ালা একে তার জন্য বহুগুণে বর্ধিত করে দেবেন’ (সূরা বাকারা, আয়াত নং-২৪৫)।
আল্লাহ তায়ালা জান-মাল-সময় সবকিছু থেকে কর্জ চেয়েছেন। আমরা কি তৈরি আছি আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় আল্লাহরই প্রদত্ত রিজিকের (জান, মাল, সময়) কিছু অংশ ব্যয় করতে? যা আল্লাহ তায়ালা বহু গুণে বর্ধিত করে পরিশোধ করবেন? আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার এ লাভের আহ্বান কি আমাদের লোভী করে তুলতে পারে না? আমরা একটু ভাবি এবং বুদ্ধিমান হই।
লেখক : কথাশিল্পী