আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করার আয়োজন!
এবার আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বাকিতে রাখার প্রস্তাব অনুমোদন করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে শত ভাগ প্রভিশন বা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা দিয়ে। বর্ধিত খেলাপি ঋণের বিপরীতে বর্ধিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করায় ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়; কিন্তু ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান শক্তিশালী থাকে। তাই ব্যাংকের ভিত্তি শক্তিশালী রাখার জন্য প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু এ প্রভিশন বাকিতে সংরক্ষণের অনুমোদনে দিচ্ছে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন প্রায় দেড় ডজন ব্যাংককে এক বছরের প্রভিশন সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণের সময় দেয়া হয়েছে। এতে এক দিকে প্রকৃত মুনাফা না হলেও বাড়তি মুনাফা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর এ বাড়তি মুনাফার ওপর ৪০ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স দিতে হচ্ছে সরকারকে। একই সাথে বর্ধিত মুনাফাকে ভিত্তি ধরে ব্যাংক বেশি হারে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিচ্ছে। এতে আড়াল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা। এভাবে চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করবে বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত গ্রহণ করে তার ৮৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে থাকে। একটি নির্ধারিত সময় পর মুনাফাসহ আসল পরিশোধ করতে হয় আমানতকারীদের। আমানতকারীদের অর্থ যথাসময়ে ফেরত দেয়ার সক্ষমতা রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ও ব্যাংক কোম্পানি আইনেও নানা বিধিবিধান দেয়া রয়েছে। যেমন বিনিয়োগকৃত অর্থ খেলাপি হয়ে গেলে খেলাপি ঋণের ধরন অনুযায়ী একটি নির্ধারিত হারে অর্থ ব্যাংকের কাছে সংরক্ষণ করতে হয়। এটাকেই ব্যাংকিং ভাষায় প্রভিশন সংরক্ষণ বলা হয়। তাই খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ করলে সব ধরনের ঝুঁকিমুক্ত থাকে একটি ব্যাংক। যেমন, একটি ব্যাংক একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকা আমানত গ্রহণ করল। পাঁচ বছর পর তার আসল ও মুনাফাসহ ২০০ টাকা ফেরত দিতে হবে। কিন্তু ১০০ টাকার আমানতের পুরোটাই যদি মন্দ মানের খেলাপি ঋণ হয়ে যায় তাহলে পাঁচ বছর পর ওই ব্যাংক আর আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো প্রতি বছর যে পরিমাণ মুনাফা করবে তা থেকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে একটি নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর খেলাপি ঋণের ধরন অনুযায়ী ২৫ শতাংশ থেকে শতভাগ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি হয়। আর এ ঘাটতি বেশি দিন থাকলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তিই দুর্বল হয়ে যায়, যা একটি ব্যাংকের যেকোনো ধরনের বিপর্যয় যেকোনো সময় দেখা দেয়ার কারণ হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। যেমন, একটি ব্যাংকের এক বছরে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে; কিন্তু ব্যাংকগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ২০ কোটি টাকা করে পাঁচ বছরে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারবে এসব ব্যাংক; কিন্তু পরের বছরই আবারো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হচ্ছে। নতুন প্রভিশন ঘাটতির সাথে পুরনো ঘাটতি যুক্ত হওয়ায় একপর্যায়ে পুরো মূলধনই আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে বাকিতে প্রভিশন ঘাটতি অনুমোদন দেয়ায় ব্যাংকের আয় বেড়ে যাচ্ছে। কারণ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। যেমন, একটি ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকার প্রভিশনের বিপরীতে ৮০ কোটি টাকা বাকি রাখা হলে ব্যাংকের ৮০ কোটি টাকা আয় বেড়ে যায়। আর এ আয়ের ওপর ভিত্তি করে ৪০ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স সরকারের ঘরে চলে যায়। তাহলে দেখা গেল আয় না হলেও বর্ধিত হারে আয় দেখানোর সুযোগ থাকায় ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকা করপোরেট ট্যাক্স চলে যাচ্ছে। আবার বাকি যে ৬০ কোটি টাকা থাকছে তা থেকে বড় একটি অংশ ডিভিডেন্ড আকারে শেয়ারহোল্ডারদের অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকের মূলধন পুরোপুরি ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। কারণ, প্রভিশন হলো ব্যাংকের একটি অন্যতম প্রধান সূচক। এটা গোপন করলে একটি ব্যাংক ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। কারণ, এতে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে প্রকৃত মূলধনের চেয়ে বেশি মূলধন দেখানো হবে। আর প্রভিশন ঘাটতি কম দেখানোর ফলে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফার চেয়ে বেশি মুনাফা দেখানো হচ্ছে। প্রকৃত মুনাফার চেয়ে বেশি দেখানোর কারণে বেশি হারে সরকারকে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। বাকিতে প্রভিশন ঘাটতি সমন্বয়ের অনুমোদন দেয়ায় ব্যাংকের আর্থিক সূচকের ধাপও পরিবর্তন হচ্ছে না। প্রকৃত অবস্থা আড়াল করায় সাধারণ আমানতকারীরা প্রতারিত হচ্ছেন। যেমন, একটি ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা একজন গ্রাহক জানতে পারলে ওই ব্যাংকের দক্ষতা ও সক্ষমতা অনুযায়ী গ্রাহক আমানত রাখতে পারতেন; কিন্তু প্রকৃত অবস্থা আড়াল করায় এক দিকে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হন, অপর দিকে ব্যাংকের আমানতকারীরাও প্রতারিত হন। এটা হতে দেয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তিনি মনে করেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাত বড় সমস্যায় পড়ে যাবে, যার বিরূপ প্রভাব পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেখা দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাকিতে মূলধন সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়ায় সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার বেশি দেখানো হচ্ছে। অথচ প্রকৃত অবস্থা দেখানো হলে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন পর্যাপ্ততার হার কমে যেত। অথচ যেভাবে বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে এটা চলতে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো সামনে আর প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারবে না। সামগ্রিক ব্যাংকের ওপরই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, একটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংক নগদে লভ্যাংশ দিতে পারে না। কোনো নতুন ব্যাংক শাখা খোলার অনুমোদনও পায় না। ক্যামেল রেটিং ব্যাংকটির খারাপ হয়। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ার মূল্য কমে যায়। অনুমোদন পায় না বৈদেশিক বাণিজ্য লেনদেনের জন্য (এডি) শাখা খোলার। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাধারণ গ্রাহকও প্রতারিত হন। এর উদাহরণ হলো সাবেক ফারমার্স ব্যাংক। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সাধারণ গ্রাহকও ব্যাংক থেকে আমানত ফেরত পাচ্ছেন না। অথচ ব্যাংকটি সম্পর্কে প্রকৃত অবস্থা জানতে পারলে গ্রাহক প্রতারিত হতেন না। ওই সূত্র জানিয়েছে, যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দিচ্ছে তা কোনো হিসাববিজ্ঞানের নীতিমালার আওতায় পড়ে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব বিষয় বিবেচনা না করে বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়ায় পুরো ব্যাংকিং খাতকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে, যা কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না।