অজানা আতঙ্ক নুসরাত পরিবারে, বাড়তি নিরাপত্তা দাবি
ফেনীর সোনাগাজীর বহুল আলোচিত মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হবে। মাত্র সাড়ে ছয মাসের মাথায় নিষ্পত্তি হতে চলেছে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলা। রায়কে ঘিরে রাফির পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঘোষণা থেকে রায় কার্যকর পর্যন্ত তারা বাড়তি নিরাপত্তা দাবি করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার কার্যালয়ে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি যৌন হয়রানির শিকার হন। এ ঘটনায় তার মা শিরীন আক্তার বাদি হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই দিনই স্থানীয়দের সহযোগিতায় পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করে। ঘটনায় সিরাজের পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয় শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। সিরাজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে মহলবিশেষ রাফির পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে।
উল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষার কক্ষ থেকে ডেকে মাদরাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে কেরোসিন দিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তার আর্তচিৎকারে মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারী ও পুলিশ এগিয়ে এসে উদ্ধার করে দ্বগ্ধ নুসরাতকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাকে প্রেরণ করেন। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের জন্য প্রথমে ওসি (তদন্ত) কামাল হোসেন, পরে পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। এ মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো: শাহআলম এ ঘটনায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় পিবিআই অন্য পাঁচজনকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করলে আদালত তা অনুমোদন করেন। গত ২৭ জুন মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী নুসরাতে বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় গ্রেফতারকৃত মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, ছাত্রদল নেতা নূর উদ্দিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুসরাতের সহপাঠী উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম শরীফ, হেফজ বিভাগের শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। অপর চারজন হলেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, মাদরাসার প্রভাষক নুরুল আবছার ও মোহাম্মদ শামীম।
মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, মাত্র ৬১ কার্যদিবসে বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হতে চলেছে, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হাফেজ আহম্মদ বলেন, ৮৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য, মামলার আলামত উপস্থাপন ও আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে এ হত্যা মামলার প্রকৃত চিত্র আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আসামীদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ সাজা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ দিকে হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে নুসরাত জাহান রাফির পরিবারে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাবা ও ভাইয়েরা গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। মা শিরীন আক্তারও মেয়ের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে পৌর শহরের উত্তর চরছান্দিয়ায় গেলে দেখা যায়, বাড়ি ঘিরে সুনসান নীরবতা। বাড়ির দরজায় যথারীতি পুলিশ পাহারা রয়েছে। রাফির মা শিরীন আক্তার বলেন, তিনি হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। তবে কিছু দিন ধরে তারা আতঙ্কগ্রস্ত বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘এক সিরাজের (মাদরাসার অধ্যক্ষ) বিরুদ্ধে মামলা দেয়ায় আমার মেয়েকে তারা পুড়িয়ে মেরেছে। এখন তো ১৬ জন আসামি। সুতরাং আমরা কেমন চাপে আছি আপনারা বুঝে নিন।’ ঘটনার পরপরই পুলিশ ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পিবিআই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে। একই সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলাটির বিচারকাজ শেষপর্যায়ে আসায় তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় দোষীদের এমন শাস্তি দেয়া হোক যাতে আর কোনো রাফি যেন বর্বরতার শিকার না হয়। তিনি রায় কার্যকর পর্যন্ত বাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তা আরো বাড়ানোর জন্য দাবি জানান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনাগাজী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মঈন উদ্দিন আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আলোচিত এ হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র নুসরাত রাফির বাড়িতে আরো নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। এ ছাড়া যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সদা সতর্ক রয়েছে।